এক
গজনীর রাজপ্রাসাদ সংলগ্ন রাজকীয় উদ্যান। তিনজন ব্যক্তি মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সেখানে। আনসারী, আসজাদী এবং ফারুকী। তিনজন কবি তারা। সামান্য কবি নন, সুলতান মাহমুদের রাজদরবারের সভাকবি। একসাথে মনোরম উদ্যানে মনোমত বিহার করছেন।
হঠাৎ জীর্ণবেশে এক আগন্তুক এসে পড়লেন তাদের সামনে। কবিগণ যারপরনাই বিরক্ত। সরাসরি যেতে বললেও খারাপ দেখায়। কবিরা কৌশলে লোকটিকে দূর করতে চাইলেন। কবি আনসারী আগন্তুককে বললেন যে তারা সকলেই কবি। কবি ছাড়া অন্য কারও সান্নিধ্য তারা পছন্দ করেন না। লোকটি তখন বিনীতভাবে জানাল যে সে নিজেও তাদের মত কাব্য সাহিত্যের অনুরাগী।
এ তো ভাল আপদ জুটল! এই লোক না কি কবি! আচ্ছা ভাল কথা। কবিই যদি সে হয়, তবে সে তা প্রমাণ করুক। তিন কবি যুক্তি করে আগন্তুককে বললেন, তারা তিনজন একটি একটি করে কবিতার তিনটি চরণ বলবেন। সে যদি ঠিকমত চতুর্থ চরণ বলতে পারে, তবে তাকে তারা কবি বলে মেনে নেবেন।
চতুর কবিরা এমনভাবে তিনটি চরণ বললেন যেন ৪র্থ চরণে অন্তমিল দেওয়ার মত আর কোন শব্দ না থাকে এবং আসলেই প্রথম তিন লাইনের সাথে মিল দেওয়ার মত আর কোন শব্দ ফারসি ভাষায় ছিল না। কিন্তু লোকটি ঠিকই ছন্দ, ভাব আর অন্তমিল মিলিয়ে খুব সুন্দর করে চতুর্থ চরণ বলে দিলেন!
তারা বলেছিলেন-
আনসারী: চুঁ আরেজে তু মাহনা বাসাদ রওশন
আসজাদী: মানান্দে রোখত গোলনা বুয়াদ দর গোলশন
ফারুকী: মেজগানাত হামী গোজার কুনাদ আজ জওশন
আগন্তুক: মানান্দ সেনানে গেঁও দরজঙ্গে পুশন
বাংলা:
চন্দ্রাধিক জ্যোতির্ময় তোমার বদন
এত মনোরম নয় গোলাপ কানন
চোখের ভ্রূদ্বয় করে বর্মের ভেদন
এ যেন গেঁওর অস্ত্র, সমর পুশন
তিনজন কবির বলা রওশন, গোলশন আর জওশন শব্দের সাথে মিল আছে এমন কিছু আর ফারসিতে নেই। আগন্তুক তাই ‘পুশন’ যুদ্ধক্ষেত্রের নাম মিলিয়ে সুন্দরমত চতুর্থ চরণ নির্মাণ করেছেন। গেঁও একজন বীর যোদ্ধার নাম। আগন্তুক বলেছেন, প্রিয়ার ভ্রূদ্বয় যেন পুশন রণভূমির যোদ্ধা গেঁওর অস্ত্রের মত। এই লাইনে তিনি ছন্দ, ভাব এবং অন্তমিল সবকিছুই অক্ষুণ্ন রেখেছেন।
এই অপরিচিত ব্যক্তির অসাধারণ কাব্যপ্রতিভায় মুগ্ধ হলেন সভাকবিরা। শুধু যে মুগ্ধ হলেন তা নয়, ঈর্ষান্বিতও হয়েছেন। এই কবি যদি রাজসভায় ঢোকে, তাহলে তাদের সব প্রতিভাই এঁর কাছে ম্লান হয়ে যাবে তাতে আর সন্দেহ নেই। তাই নিজেরা কবির অনেক প্রশংসা করলেও তাকে রাজদরবারে নিয়ে যেতে অনীহা প্রকাশ করলেন।
যে কবির কথা বলছি, নাম তাঁর আবুল কাশিম। পুরো নাম ‘আল আমীর হাকিম আবুল কাশিম মনসুর ইবনে আল হাসান’
দুই
প্রাচীণ পারস্যের মহাকবি ফেরদৌসী ও হাকিম ওমর খৈয়াম ছিলেন পৃথিবীর শক্তিমান কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম। আর ইরানকে বলা যায় পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ও শিক্ষাকেন্দ্র। কারণ এখান থেকেই বিশ্বজুড়ে জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন কবি ফেরদৌসি, শেখ সাদি, হাফিজ, ওমর খৈয়াম ও আল বিরুনির মতো সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও পণ্ডিত ব্যক্তিরা।
পৃথিবীর বুকে বিশ্ববিখ্যাত যে ক’জন কবির আগমন ঘটেছে ‘মহাকবি ফেরদৌসী‘র নাম তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন একাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবি।
বহুবছর আগে মহাকবি ফেরদৌসী ইন্তেকাল করলেও আজও বহু পাঠকের কন্ঠে উচ্চারিত হয় তার লেখা কবিতা। কি যেন আকর্ষণ ও সত্য লুকিয়ে রয়েছে তার কবিতায়, নেই কোন বিরক্তি, অতৃপ্তি ও তিক্ততা। যতবার পড়া হয় ততবারই যেন ইচ্ছে হয় শুনতে বা পড়তে।
মহাকবি ফেরদৌসীর জীবন ও সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য বিশেষ কিছু জানা যায় না। তার মৃত্যুর প্রায় এক শতাব্দি পরে ইরানের বিখ্যাত কবি নিজামি আরযী তার দিবাচায় ফেরদৌসী সম্পর্কে যা লিপিবদ্ধ করেছেন তা থেকে জানা যায়, মহাকবি ফেরদৌসী ৯৪১ খ্রীষ্টাব্দে ইরানের সমরকন্দের অন্তর্গত তুস নগরের বাঝ নাম স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম আবুল কাসেম। ফেরদৌসি তার উপাধি।
গজনির সুলতান মুহাম্মদ তাকে এ উপাধি দিয়েছিলেন। সে থেকেই তিনি ফেসদৌসি নামে খ্যাতি লাভ করেন। তার পিতা মোহাম্মদ ইসহাক ইবনে শরফ শাহ তুস নগরের রাজকীয় উদ্যানের তত্বাবধায়ক ছিলেন। ফেরদৌসী ভালো লেখাপড়া শিখেছেন। তার আর্থিক অবস্থা ছিল মোটামুটি স্বচ্ছল। জানা যায়, তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে অনেক জায়গা জমি পেয়েছিলেন এবং জমি থেকে প্রতি বছর প্রচুর অর্থ আয় হত।
তিন
তিনি বাল্য বয়স থেকেই কবিতা লিখতে ভালবাসতেন। কম বয়সেই বিয়ে করেন। যৌবনে তিনি একান্তভাবে কবিতা চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন এবং রাজকীয় উদ্যানের পার্শ্ববর্তী ছোট্ট নদীর তীরে বসে কাব্য লিখতেন। সুখ ও শান্তিময় জীবনের দিনগুলো এখানেই তিনি কাটাতেন। কিন্তু সুখ তার জীবনে বেশিদিন স্থায়ী ছিল না। তার পরিবারে তুসের শাসনকর্তার খারাপ দৃষ্টিতে পতিত হল। অবশেষে নিজ গৃহে অবস্থান করাই তার জন্য দুঃসাধ্য ব্যাপার। তার মাত্র একটি কন্যা সন্তান ছিল।
কন্যাকে সৎপাত্রে বিবাহ দেওয়াছিল তার জীবনের বড় আশা। এছাড়া নিজ দেশের জনগনের দুঃখ দুর্দশা অভাব অনটন দেখে তার মন প্রায়ই কেদে উঠত। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, যে ভাবেই হোক তিনি জনগনের দুঃখ দুর্দশা দুর করবেন। কিন্তু তার মনের এ আকাঙ্খা আর পূরন হল না।
নিজ গৃহে অবস্থান করাই যখন তার অসম্ভব হয়ে উঠল। তখন জনগণের কল্যানে কাজ করবেন কিভাবে। তিনি কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে নিজগৃহ থেকে বেরিয়ে পড়লেন অজানা এক নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। তার জীবনের এ দুঃ সময়ে সাক্ষাৎ পেলেন গজনীর সুলতান মাহমুদের।
চার
৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদ গজনীর সিংহাসন আরোহন করেন। তিনি দেশ বিদেশের জ্ঞানী ব্যক্তিদের খুব সম্মান করতেন এবং তাছারা তার দরবারে দেশ বিদেশের কবিদের কবিতা আবৃত্তির আসর হত। মহাকবি মুহম্মদ আবুল কাশেম ফেরদৌসী সুলতান মাহমুদের নিকট যথাযথ কদর পাবেন চিন্তা করে গজনীর উদ্দেশ্য রওনা দেন। গজনীর রাজ দরবারে প্রবেশ করা ছিল তখন কঠিন ব্যাপার। তিনি দরবারের অন্যান্য কবিদের ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হন। অবশেষে সুলতান মাহমুদের উজির মোহেক বহাদুরের সহযোগিতায় তিনি রাজদরবারে প্রবেশ করেন। সুলতানের সঙ্গে কবির প্রথম পরিচয় হয় কয়েকটি কবিতা পাঠের মাধ্যমে।
প্রথম সাক্ষাতেই সুলতান কবির আবৃত্তি করা কয়েকটি কবিতা শুনে অত্যান্ত মুগ্ধ হন এবং এ বলে কবিকে সংবর্ধনা করেন, আয় ফেরদৌসী , তু দরবারে মে ফেরদৌস কারদী। অর্থাৎ হে ফেরদৌসী, তুমি সত্যিই আমার দরবারকে বেহেশতে পরিণত করে দিয়েছ।
এ থেকেই কবির নাম ফেরদৌসী হল এবং পরবর্তীতে তিনি ফেরদৌসী হিসেবেই খ্যাতি লাভ করেন। সুলতান কবির জন্য পৃথকভাবে উন্নতমানের বাসস্থান ও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং কবিকে রাজ কবি হিসেবে মনোনীত করেন। ধীরে ধীরে কবি ফেরদৌসীর সঙ্গে সুলতান মাহমুদের সম্পর্ক গভীর হয়ে যায়। কবির কবিতা ও তার জ্ঞান বুদ্ধিতে সুলতান তার প্রতি মুগ্ধ হন। কিন্তু এখানেও সুলতানের সঙ্গে কবির গভীর সম্পর্ক আজীবন স্থায়ী হল না।
পাঁচ
কবি ফেরদৌসীর সাথে সুলতানের গভীর সম্পর্ক এবং রাজদরবারের কবির শ্রেষ্ঠ সম্মান দেখে রাজসভার অন্যান্য কবিরা ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠল এবং কবিকে রাজদরবার থেকে বের করার জন্য কবির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র শুরু করল। অন্যদিকে সুলতানের প্রধানমন্ত্রী খাজা ময়মন্দাও কবির সঙ্গে গোপন শত্রুতা আরম্ভ করলো। ইতমিধ্যে সুলতান মাহমুদ কবিকে ‘ মহাকাব্য শাহনামা’ রচনা করার অনুরোধ জানান এবং এর প্রতিটি শ্লোকের জন্য একটি করে স্বর্ণমুদ্রা দিবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। যতদুর। কবি সুদীর্ঘ ৩০ বছর পরিশ্রম করে শাহনামা রচনা করেন। এর মধ্যে শেষের ২০ বছর কবি রাজসভাতে কাটান। শাহনামা প্রথিবীর সহাকাব্য সমূহের অন্যতম। ইহা ৭টি বৃহৎ খন্ডে খন্ডে বিভক্ত এবং ৬০ হাজার শ্লোক রয়েছে এতে। কাব্যের কোথাও অশ্লীল বাক্য বা ইতর উপমার প্রয়োগ নেই। কবি নিযামীর মতে শাহনামা কাব্য রচনা শেষ হয় হিজরী ৩৯৩ সনে। শাহনামা কাব্য রচনা শেষে সুলতান রাজদরবারের কতিপয় ঈর্ষাপরায়ন ও ষড়যন্ত্রকারীর কুমন্ত্রণা শুনে তার প্রতিশ্রুতি ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা না পেয়ে ক্রোধে, ক্ষোভে ও দুঃখে কিংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে গেলেন। কবি অর্থের লোভী ছিলেন না। বরং সুদীর্ঘ ৩০ বছর পরিশ্রমের বিনিময়ে তাকে যে অর্থ দেয়া হয়েছে তা কবি নিজের জন্য অপমান মনে করেছেন। ফেরদৌসী দীন হতে পারেন কিন্তু তার আত্না দীন নয়।
এছাড়া এ অর্থ দিয়ে নিজ দেশের অসহায়, গরীব নিপীড়িত নির্যাতিত জনগনের এবং কন্যা সন্তানের যে উপকার করবেন বলে মনস্থ করেছিলেন তা যেন সবই ব্যর্থ হয়ে গেল। সুলতান হয়ে তিনি কিভাবে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে পারলেন? এসব চিন্তা করেই কবি সুলতানের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং কবিকে সুলতানের দেয়া সমুদয় অর্থ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। শুধু তাই নয় সুলতানের দেওয়া সমুদয় অর্থ ভৃত্য, স্নানাগারের রক্ষক নিকটস্থ গরীব লোকদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে দেন। রাজ পুরস্কারকে অপমান কবার ঘটনা সুলতানের কানে পৌছল।রাজসভার অন্যান্য কবি ও আমলারা সুলতানকে বিষয়টি ভালভাবে বুঝায়নি বরং তারা সুলতানের নিকট কবির বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়েছেন। তারা সুলতানের কাছে কবির বিরুদ্ধে ষড়যঙযন্ত্রমূলকভবে মিথ্যা ও বানোয়াট কথাবার্তা বলে কবির বিরুদ্ধে সুলতানকে ক্ষেপিয়ে তোলেন। সুলতান ক্ষুদ্ধ হয়ে কবিকে হাতির পদতলে পিষ্ট করে হত্যা করা আদেশ দেন এবং পরক্ষনে এ আদেশ তুলে নিয়ে গজনী ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। সুদীর্ঘ ২০ টি বছর কবি কাটিয়েছেন গজনীতে। তার জীবনের মূল্যবান সময় এবং শ্রম ব্যায় হয়েছে এখানে।
ছয়
কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে এবং বিরক্ত হস্তে জীবন সায়াহ্নে গজনী ত্যাগ করে আবার বের হতে হল অজানা অচেনা নিরাপদ এক আশ্রয়ের সন্ধানে। গজনী ত্যাগ করার আগে কবি আবার বের হতে হল অজানা অচেনা নিরাপদ এক আশ্রয়ের সন্ধানে। গজনী ত্যাগ কবার পূর্বে কবি সুলতান মুহমুদের এ হীনমন্যতার জন্য তাকে গাল মন্দ করে একটি ব্যঙ্গ রসাত্নক কবিতা লিখেন এবং তা মিসজিদের দেয়ালে টাঙিয়ে রাতের অন্ধকারে গজনী ত্যাগ করেন। ইতিপূর্বে কবির সুখ্যাতি দেশ বিদেশে যেমন ছড়িয়ে পড়েছিল , তদুরুপ রাজদরবারে কবির ভাগ্য কবির বিপর্যয়ের কথাও ইতিমধ্যে বহুদুর ছড়িয়ে পড়ল। গজনী ত্যাগ করে কবি কুহেস্তান রাজ্য রাজা নসরুদ্দি মুহতাসেমের নিকট রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহন করেন।কবি ফেরদৌসী সুলতান মাহমুদকে প্রতারণা ও হীনমন্যতার কথা ভুলতে পারলেন না। এখনে অবস্থানকালেই কবি সুলতান মুহমুদকে উপলক্ষ্য করে একটি ব্যাঙ্গরচনা কাব্য প্রণয় করেন।
সুলতান মাহমুদ ছিলেন রাজা নসরুদ্দিন মহতাসেমের একান্ত বন্ধু মানুষ। তাই রাজা কাব্যটি পাঠ করে খুব দুঃখ পান। কাব্যটি বন্ধুর জন্য খুবই অবমাননাকর মনে করে রাজা কবিকে বিনয়ের সাথে অনুরোধ করে কাব্যটি কিছু অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করেন এবং তা বিনষ্ট করেন। রাজনৈতিক আশ্রয়ে এখানে কবির দিনগুলি খুবই সম্মানজনক ও আনন্দের সাথে কাটছিল। কবিকে গ্রহণ করার জন্যে দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আমন্ত্রন আসে কিন্তু কবি কোন আমন্ত্রন গ্রহন না করে এখান থেকে চলে যান বাগদাদে। বাগদাদের তৎকালীন শাসনকর্তা কবিকে পেয়ে খুবই আনন্দিত হন।
বাগদাদ অবস্থানকালে কবি ইউসুফ জুলেখার কাহিনী নিয়ে ১৮০০০ শ্লোকের একটি প্রেমের কাব্য রচনা করেন। কিন্তু কাব্যটি অতীতের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এছাড়া তিনি আরো বহু কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। বাগদাদে কিছুদিন অবস্থান করে কবি চলে যান নিজ মাতৃভূমি তুস নগরে।
ইতোমধ্যে ন্যায় বিচারক হিসেবে পরিচিত সুলতান নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। তিনি মর্মে মর্মে অনুভব করতে পেরেছিলেন যে , কবি তার প্রতিশ্রুত স্বর্ণমুদ্রা না পেয়ে দুঃখ পেয়েছেন। রাজসভার অন্যান্য কবি এবং আমলারা কবির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করেছিল এ কথাও সুলতানের নিকট আর গোপন রইল না। তিনি প্রধানমন্ত্রী খাজা ময়মন্দীকে রাজপদ থেকে বহিস্কার করেন এবং অনতিবিলম্বে কবিকে ফিরিয়ে আনার সংকল্প ব্যক্ত করেন। কিন্তু মানব মন স্থায়ী নয়। সুলতানকে হেয় করে কবির পূর্বে লেখা কবিতাটি সুলতানের মনে পড়ে যায়। এত সুলতান ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে কবিকে গ্রেফতার করে রাজদরবারে নিয়ে আসার জন্য একটি প্রত্রসহ বাগদাদে দূত প্রেরণ করেন।
কিন্তু বাগাদাদ থেকে কবিকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বরং বাগদাদের শাসনকর্তা সুলতানের প্রেরিত পত্রের এক কোনে আলিফ,লাম ও মীম এ তিনটি অক্ষর লিখে দেন। সুলতান মাহমুদ পত্রে এ তিনটি অক্ষর দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি বিংবা রাজদরবারের কবি ফেরদৌসির অভাব দারুণ ভাবে অনুভব করেন। আজ যদি কবি ফেরদৌসী দরবারে থাকতেন তাহলে এর অর্থ বুঝার জন্য রাজদরবারের বাইরে যেতে হতো না। সুলতানের ঘনিষ্ঠ কুয়েস্তানের রাজা নসরুদ্দিন সুহতাসেন কবি ফেরদৌসীর উচ্চ প্রশংসা করে সুলতানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কুয়েস্তানের রাজা নসরুদ্দিন মুহতাসেন কবি ফেরদৌসীর উচ্চ প্রশংসা করে সুলতান মাহমুদের নিকট একটি পত্র প্রেরণ করেন। পত্র পাঠান্তে সুলতান মর্মাহত হন। তিনি বুঝতে পারলেন যে সুলতান কবির প্রতি ন্যায় বিচার করেননি বরং ষড়যন্ত্রকারীদের কুপরামর্শে তিনি কবির প্রতি অন্যায় আচরন করেছেন। তাই সুলতান নিজেই অপরাধী মনে করে কবি ফেরদৌসীকে ক্ষমা করে দেন এবং কবির প্রতি সুলতানের সম্মান প্রদর্শনের নিদর্শন স্বরুপ কবির প্রাপ্য সমুদয় স্বর্ণমুদ্রাসহ কবির জন্মভূমি ইরানের তুস নগরীতে কবির নিজ বাড়িতে দূত পেরণ করেন। কিন্তু দূত যখন স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে যান তখন কবি পৃতিবীতে বেচেঁ নেই।
শাহনামাতে সময়ের ব্যবধানে ৫০ জন শাসকের উত্থান-পতনকে তুলে আনা হয়েছে, যা শুরু হয়েছিল প্রথম মানুষ কাইয়ুমারস থেকে এবং শেষ হয়েছে ইয়াজদিজর্দের পতনের মধ্য দিয়ে। ছয় হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যেন পরবর্তী প্রজন্ম ভুলে না বসে, অনেকটা এজন্যই ফেরদৌসীর প্রয়াস। শাহনামা ফার্সি ভাষাকে যে ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে গেছে, এক হাজার বছর পরেও তা অপরিবর্তিত। এই জন্যই মহাকবি গ্যাটে ফার্সি সাহিত্যর সুনাম করে লিখে গেছেন তার West-East Divan। এজন্যই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল সাদী, জামী, রুমি, হাফিজ, আত্তার কিংবা সানাইয়ের মতো পরবর্তী দুনিয়া কাঁপানো ফার্সি কবিরা।
দ্বাদশ শতকের কবি খাকানি যথার্থই বলেন,
বিষাদ গূঢ় অন্ধকারে জ্ঞানীর গাঢ় বাতি
ফেরদৌসীর কথার সাথে তুল্য শুধু তাই;
ফেরেশতাদের মতোন সেই তীব্র অনুভূতি
অমন করে লিখবে যারা ফেরেশতা তারাই।
(লেখক কর্তৃক অনূদিত)
বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন অনুবাদ থাকলেও বাংলা ভাষায় শাহনামার সবথেকে প্রামাণ্য অনুবাদ ৬ খণ্ডে প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি। প্রাঞ্জল এই অনুবাদ প্রায় ১৭ বছর সময় নিয়ে করেছেন মনিরউদ্দীন ইউসুফ ‘ফেরদৌসীর শাহনামা’ নামে।
১০২০ খ্রিষ্টাব্দে মতান্তরে ১০১৪ খ্রিষ্টাব্দে কবি এ অশান্তময় পৃথিবী থেকে চির বিদায় গ্রহণ করেন। কবির ইন্তেকালের হাজার হাজার বছর অতিবাহিত হলেও কবি ও কাব্য সাহিত্য পৃথিবীতে রেখে গেছেন তাতে মুসলিম জাতি কর্তৃক কবিকে কখনো ভুলার মত নয়।
লেখক: ফাইজুল ইসলাম ফাহিম, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
এন.এইচ /প্রেজেন্ট নিউজ