রাবি প্রতিনিধি :
সাড়ে ৩ হাজার টাকা বেতনে ১৬ বছর ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শহীদ জিয়াউর রহমান হলে ক্লিনার (সুইপার) হিসেবে কাজ করছেন রাজেস দাস। ২০০৫ সালে সংসারের খরচ মিটাতে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে চাকরি নেন তিনি। সে সময় তার বেতন ধরা হয় ০১ হাজার টাকা। দু-দেড়’শ করে বাড়তে বাড়তে তা দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৩ হাজারে।
এ সময়ের মধ্যে পরিবারের সদস্য সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে বহুগুণে। সংসারের খরচ চালাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ ঘণ্টার ডিউটি শেষ করে রাজশাহীর বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতেন তিনি। তবুও পাঁচ সদস্যের পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। মাস শেষ হবার আগেই বেতনের টাকাসহ জমানো টাকাও ফুরিয়ে যায়। শুরু হয় ধার-কর্জ। মুখে হতাশার চাপ নিয়ে এসবই বলছিলেন তিনি।
রাজেস দাস রাজশাহীর রাজপাড়া থানার লক্ষ্মীপুর রামকৃষ্ণপল্লী গ্রামের বাসিন্দা। ৫ সদস্যের পরিবার তার। দুই মেয়ের মধ্যে ছোট মেয়ে লক্ষ্মীপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীতে পড়ছে। আর বড় মেয়ের বিয়ে হলো কিছুদিন হলো। আর এক ছেলে তপুমল্লীগ ‘আল হাজ’ কলেজে পড়াশোনা করছে।
২০০৫ সালের অগাস্ট মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জিয়াউর রহমান হলে বহিরাগত ‘ক্লিনার’ হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। সেসময় তার বেতন ধরা হয় ১ হাজার টাকা। সেখান থেকে বাড়তে বাড়তে ২০২১ সালের শেষ পর্যন্ত তার বেতন হয় সাড়ে ৩ হাজার। এরপর হলটিতে নতুন প্রাধ্যক্ষ নিয়োগ হলে তিনি আরও দেড় হাজার টাকা বাড়িয়ে ৫ হাজার টাকা করে দেন।
রাজেস দাস জানিয়েছেন, ‘এই অভাবের সংসার চালাতে গিয়ে অনেক সময় আত্মহত্যার মতো জগণ্য কাজ করারও চেষ্টা করেছি। কিন্তু সংসারের আমিই যে একমাত্র অভিভাবক। তা মাথায় রেখেই কষ্ট করে জীবন চালাচ্ছি। তিনি বলেন, শহীদ জিয়াউর রহমান হলে আমিসহ মোট চার জন সুইপার (ক্লিনার) রয়েছে। আমি ছাড়া বাকি তিন জন স্থায়ী সুইপার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত। আমার সঙ্গে একই কাজ সমান সময় দিয়ে তারা বেতন পাচ্ছে ৪০-৪৫ হাজার টাকা করে।’
স্ত্রী ও তিন ছেলে-মেয়েসহ পরিবারের ৫ সদস্যকে নিয়ে কীভাবে সংসার চালাচ্ছেন, তার বর্ণনা দিয়েছেন রাজেস দাস। তিনি জানান, ‘১৬ বছর ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই হলে কাজ করছি। দিন যত যাচ্ছে দ্র্যব্যমূল্যের দাম বহুগুণে বাড়ছে। কিন্তু আমার বেতন বাড়েনি। প্রথমে এক হাজার টাকা ছিল। এরপর একশ-দুইশ করে বাড়তে বাড়তে সাড়ে ৩ হাজারে দাঁড়িয়েছে, ১৬ বছর এই বেতনেই চলছিল। হলের নতুন প্রভোস্টকে অনুরোধ করার পর তিনি আরও ১৫’শ বাড়িয়ে ৫ হাজার টাকা করেছে। সপ্তাহে ৬ দিন হলে সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ২ টা পর্যন্ত ৫ ঘণ্টা সময় দিতে হয়। এরপর আমি রাজশাহীর বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে যাই। তবুও ধার-কর্জ করে চলতে হয়। মাছ-মাংস তো কেনাই হয় না। বাজারে সবজির দামও বেশ চড়া। কোনোরকম কম দামের সবজি কিনে চলছি। ছেলে-মেয়েদের প্লেটে কখনও মাছ-মাংস দিতেই পারিনা।’
দিন যত যাচ্ছে সবকিছুর দাম হু হু করে বেড়েই চলেছে। কিন্তু রাজেসের বেতন বাড়ছে না। অনেক পণ্যের দাম এখন সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। আবার দেশের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির খবরও শুনছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে এতো অল্প বেতনে সংসার চালাতে ধার ছাড়া উপায় থাকে কি?
এবিষয়ে শহীদ জিয়াউর রহমান হল প্রাধ্যক্ষ সুজন সেন বলেন, ‘রাজেসকে বহিরাগত সুইপার হিসেবে ২০০৫ সালের দিকে নিয়োগ দেয়া হয়। সেই সময় তার বেতন ছিল ৭০০’শ টাকার মতো। এরপর ১ হাজার, ১২’শ, ২ হাজার এভাবে বাড়তে বাড়তে সাড়ে ৩ হাজার টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে আমি আরও দেড় হাজার বাড়িয়ে ৫ হাজার টাকা করে দিয়েছি। এই টাকা হল পান্ড থেকে তাদের দেয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমি জানি এই টাকায় তার পরিবার চলতে পারে না। তবে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি তার বেতন বাড়ানোর জন্য। আমি তার এবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও জানিয়েছি। প্রশাসনেরও সদিচ্ছা আছে। এখনতো বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে। তার বিষয়ে আমি প্রশাসনের কাছে আবারও সুপারিশ করব।’
বিশ্ববিদ্যালয় উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, ‘সে এতো অল্প টাকায় এতো বছর ধরে কাজ করছে, এটি আমার জানা নেই। কিভাবে সেখানে নিয়োগ পেয়েছে বা কিসের ভিত্তিতে কর্মরত আছে সেবিষয়ে আমার বিস্তারিত জানতে হবে। তার বিষয়ে আমি খোঁজ নিচ্ছি। বিষয়টি দেখবো।’
এন.এইচ/