মুজাহিদুল ইসলাম, চট্টগ্রাম মহানগর প্রতিনিধি:
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী’র দাওরায়ে হাদীস (আরবী-মাস্টার্স) সমাপনী বর্ষের তরুণ আলেমদের ‘নাসায়ী শরীফ”র আখেরী দরস, রবিবার (২৯ জানুয়ারী’২৩) সন্ধ্যা ৭টায়
পরিচালনা করেন জামিয়ার মুহাদ্দিস ও মুঈনে মুহতামিম আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন
নাসায়ী শরীফের সিলেবাসের শেষ হাদীসের দরস শেষে আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন বিদায়ী ছাত্রদের উদ্দেশ্যে দিক-নির্দেশনা ও উপদেশমূলক প্রায় ঘন্টাব্যাপী বয়ান করেন।
এ সময় পুরো দারুল হাদীস মিলনায়তন জুড়ে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছিল এবং প্রায় আড়াই হাজার তরুণ আলেম আবেগঘন পরিবেশে গভীর মনোযোগের সাথে বয়ান শুনছিলেন।
দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্যে তরুণ আলেমদের উদ্দেশ্যে আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন বলেন, আপনারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উম্মুল মাদারিসের হাবিবী কাননে এসেছেন ইলমে নববীর জ্ঞান আহরণের মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। জ্ঞান আহরণের ধারাবাহিকতায় বিদায় লগ্ন প্রায় সমুপস্থিত। চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষা সমাপনের পর অল্প কিছু দিনের মধ্যেই আপনারা নিজ নিজ অবস্থানে কর্মমুখর জীবনে ফিরে যাবেন। জীবন চলার পথ বড়ই কঠিন ও সংকটপূর্ণ। আমাদের সন্তানদের মতোই আপনারাও আমাদের অত্যন্ত স্নেহ ও ভালবাসার পাত্র। তাই জীবন চলার পথে উপদেশ মূলক কিছু কথা বলছি, মনোযোগের সাথে শুনুন:
জীবন চলার পথে আপনারা সর্বক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সুন্নাতের পূর্ণ অনুসরণ করে চলবেন। গুরুত্বের সাথে জামাআতের সহিত নামায আদায় করবেন। দৈনিক কুরআন তিলাওয়াত করবেন। সকল উম্মতে মুহাম্মদীর ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণে নিজেদেরকে সদা নিয়োজিত রাখবেন। ইলমে ওহী এবং হুযূর (সা.) এর তরীক্বার প্রচার-প্রসারকে আল্লাহ তাআলার বিরাট এক নিয়ামত হিসাবে ধারণ করবেন, যে নিয়ামতের বিপরীতে জগতের সব কিছু নগন্য ও তুচ্ছ। সাধ্যমতো দেশ, জাতি ও উম্মাহর কল্যাণে কাজ করে যাবেন। পরিবার, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, সমাজের কল্যাণে সজাগ থাকবেন। যেখানেই থাকুন না কেন, দ্বীনি ইলমের প্রচার-প্রসারে কাজ করে যাবেন এবং দাওয়াত ও তাবলীগে সময় লাগাবেন। সুস্থির ও বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে দ্বীনি কাজ আঞ্জাম দিবেন।
এক পর্যায়ে আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন তরুণ আলেমদের উদ্দেশে রাসূল (সা.) এর অন্তিম অসিয়তের উল্লেখ করে বলেন, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাহাবায়ে কেরামের প্রতি শেষ অসিয়ত ছিল, তিনি ইরশাদ করেন, “আমি তোমাদেরকে আল্লাহ্কে ভয় করার এবং (তোমাদের আমিরের কথা) শোনার ও তাঁর অনুগত থাকার উপদেশ দিচ্ছি, হোক না সে ইমাম একজন হাবশী গোলাম। আমার পর তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে, তাদের মধ্যে অল্প দিন পরই মতভেদ দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার হিদায়াত প্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরবে এবং তা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে রাখবে। অর্থাৎ সুন্নাতের উপর খুব অটল ও অবিচল থাকবে। নবাবিষ্কৃত বিষয় থেকে বেঁচে থাকবে। কেননা, প্রত্যেক নবাবিষ্কৃত কাজই বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহী”।
আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন রাসূল (সা.)এর আরেকটি হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, সাহাবী আবু যর (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি একবার হুযূর (সা.)এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আমাকে কিছু নসীহত করুন, তিনি বললেন, আমি তোমাকে আল্লাহ্কে ভয় করার উপদেশ দিচ্ছি। কেননা, তাঁর ভয়ই সকল কাজের সৌন্দর্য। আমি বললাম, আরও কিছু নসীহত করুন। তিনি বললেন, “কুরআন তিলাওয়াত ও আল্লাহর যিকিরকে তোমার জন্য আবশ্যক করে নাও। কেননা, এর দ্বারাই আকাশে তোমার ব্যাপারে আলোচনা হবে এবং পৃথিবীতে হবে তোমার জন্য নূর”। প্রিয় নবী (সা.)এর এই নসীহতই আপনাদের জীবন পরিচালনার জন্য পথনির্দেশিকা হিসেবে যথেষ্ট মনে করি।
আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন বিদায়ী তরুণ আলেমদের উদ্দেশ্যে আরো বলেন, কিছু দিনের মধ্যেই আপনারা কর্মমুখর জীবনের দিকে পা বাড়াবেন। মনে রাখবেন, আপনারা যে পথের পথিক, সে পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, কণ্টকাকীর্ণ ও অতি পিচ্ছিল। তাই অত্যন্ত সাবধানে এই পথ অতিক্রম করে পদে পদে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। কারণ, আজ সমগ্র মুসলিম উম্মাহ বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। দেশে-বিদেশে সর্বত্রই ইসলাম ও মুসলমানগণ নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়ছেন। অন্যদিকে পাশ্চাত্য অপসাংস্কৃতিতে যেন সমাজ ডুবে আছে। বাতিল নানা রূপে, নানা ছদ্মবেশে, নানা পন্থায় ইসলামের প্রজ্বলিত প্রদীপকে নির্বাপিত করার নিমিত্তে প্রতিনিয়ত হীন অপকৌশল চালিয়ে যাচ্ছে। ঠিক এহেন দুর্দিনে আমাদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় আপনাদের মতো সুযোগ্য একদল আলেমের বৃহৎ একটি জামাত মুসলিম সমাজকে উপহার দিতে পেরে গর্ব ও আনন্দ অনুভব করছি। আপনারাই জাতির ধারক-বাহক ও কর্ণধার।
তিনি বলেন, আপনারা সাহাবা, তাবেয়ী, তবে-তাবেয়ী, মুহাদ্দেসীন, মুজতাহিদীন, আউলিয়ায়ে কেরাম, আকাবিরে দেওবন্দ ও আকাবিরে হাটহাজারী’র মাসলাকের সাথে গভীরভাবে জড়িত হওয়ায় আপনাদের কাঁধেও দাওয়াতের মহান দায়িত্ব এসে পড়েছে। এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের উদ্দেশ্যে এ ক্ষেত্রে আপনাদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আদর্শকে আক্বীদা ও আমল তথা জীবনের সর্বক্ষেত্রে শক্ত হাতে ধারণ করে চলতে হবে।
আপনারা এমন এক যুগ সন্ধিক্ষণে শিক্ষা সমাপন করে কর্মক্ষেত্রের দিকে এগিয় যাচ্ছেন, যে যুগের মানুষ কি বৈশ্বিক কি আধ্যাত্মিক; সর্বোপরি অস্থিরতার শিকার। তাই জাতি চাতক পাখির ন্যায় আপনাদের জন্য অপেক্ষমান। আপনারা ইলমী দক্ষতা, খোদাভীতি, একনিষ্ঠতা, আল্লাহর উপর ভরসা ও সুন্নাত অনুসরণের মজবুত হাতিয়ার নিয়ে দেশ ও জাতির পথপ্রদর্শনে আত্মনিয়োগ করবেন এবং তালিম, তাবলীগ, দাওয়াতি-জিহাদ, ইমামত, বক্তৃতা-বিবৃতি, ওয়াজ-নসীহত ও ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে পথহারা এই জাতিকে পথের দিশা দান করবেন।
মনে রাখবেন, এ পথ অমসৃণ ও অনেক কণ্টকাকীর্ণ। ধৈর্য, সহনশীলতা, দৃঢ়তা, গাম্ভীর্যতা, ত্যাগ-তিতীক্ষা ও সহমর্মিতা দ্বারা এসব বাধা অতিক্রম করতে হবে। পদদলিত করতে হবে যশ ও খ্যাতির লোভ লালসাকে। এতেই নিহিত রয়েছে সুদীর্ঘ এক যুগব্যাপী কঠোর সাধনার সার্থকতা। আপনারাই হচ্ছেন ভবিষ্যত জাতির কান্ডারী, দ্বীনের ধারক-বাহক। তাই আপনাদেরকে ইলম, আখলাকের প্রতিটি স্তর অতি মেহনত ও পরিশ্রমের মাধ্যমে অতিক্রম করতে হবে। দোয়া করি, মহান আল্লাহ আপনাদেরকে দেশ ও জাতির জন্য সঠিক পথপ্রদর্শক হিসেবে কবূল করুন।
দরস ও বয়ান শেষে আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন তরুণ আলেমদেরকে নিয়ে বিশেষ দোয়া-মুনাজাত পরিচালনা করেন। দোয়ায় তিনি করোনা ভাইরাস মহামারি সহ সকল রোগ-ব্যাধি, বিপদাপদ থেকে দেশ ও জাতির মুক্তি এবং কল্যাণ ও শান্তি কামনা করেন। পাশাপাশি দাওরায়ে হাদীস সমাপনী বর্ষের তরুণ আলেমদের হক্বের উপর অটল থাকা এবং বরকতময় জীবনের জন্য দোয়া করেন।