পবিত্র কাবা ঘরের গিলাফ (কিসওয়াহ) প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের প্রধান ক্যালিগ্রাফার চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার সন্তান মুখতার আলম। কাবার গিলাফে শিল্পের ছোঁয়া দিয়ে দেশের জন্য কুড়িয়েছেন সুনাম। দক্ষতার প্রমাণ রেখে রাজকীয় ফরমানে লাভ করেছেন সৌদি নাগরিকত্ব।
দেশ ও দেশের মানুষকে করেছেন গর্বিত। আর তাই খুশির আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে মুখতারের নিজের গ্রামের বাড়ি লোহাগাড়া এলাকায়ও।
সম্প্রতি সৌদি আরব সরকার তাকে সে দেশের নাগরিকত্ব দিয়ে বিরল সম্মানে ভূষিত করেছেন। এ নিয়ে তার গ্রামের মানুষের মাঝে খুশির আমেজ বিরাজ করছে। তিনি উপজেলার আধুনগর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের রশিদের ঘোনা কবির মোহাম্মদ সিকদার পাড়ার মৃত মফিজুর রহমানের ছেলে।
জানা গেছে, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ঘোষিত ‘ভিশন-২০৩০’-এর অংশ হিসেবে গত বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) সৌদি বাদশার এক রাজকীয় নির্দেশনায় বিভিন্ন পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরকে নাগরিকত্ব দেয়ার কথা জানানো হয়। ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, ইতিহাসবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও চিকিৎসক, বিনিয়োগকারক, প্রযুক্তিবিদ, ক্রীড়াবিদসহ বিভিন্ন পেশার সুনাম কুড়ানো ব্যক্তিদের মধ্যে প্রথম দিন পাঁচ বিদেশী নাগরিককে এ সম্মান দেয়া হয়। এর মধ্যে লোহাগাড়ার সন্তান ক্যালিগ্রাফার মুখতার আলমও রয়েছেন।
সোমবার সকালে ক্যালিগ্রাফার মুখতার আলমের গ্রামের বাড়িতে সরেজমিনে গিয়ে জানা গেল, মুখতার আলম আনুমানিক ১৯৬৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। দেশ স্বাধীন হবার আগে থেকে তারা সপরিবারে সৌদি আরব চলে যান। পিতা মফিজুর রহমান জীবিকা নির্বাহের তাগিদে সপরিবারে সেখানে বসবাস করে আসছেন। মাঝে মধ্যে গ্রামের বাড়িতে আসতেন। চারদিকে দেয়ালের বাউন্ডারি দেয়া একটি বসতঘরও রয়েছে এখানে। তবে ওই ঘরে কেউ থাকেন না। বাউন্ডারি ওয়ালের গেটে ঝুঁলছে তালা। তারা মাঝে মধ্যে গ্রামের বাড়িতে আসেন।
আত্মীয়-স্বজন ও আশপাশের লোকজনদের সাথে দেখা করে চট্টগ্রাম শহরে নিজেদের বাসায় অবস্থান করেন। প্রায় এক বছর আগে মুখতার আলমের পিতা চট্টগ্রাম শহরের বাসায় অবস্থানকালীন সময় মারা গেছেন। তাকে দাফন করা হয়েছে গ্রামের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে। মা শিরিন আক্তার বর্তমানে শারীরিকভাবে অসুস্থ। তিনি চট্টগ্রাম শহরের বাসায় থাকছেন।
তারা ৪ ভাই ১ বোন। মুখতার আলম সবার বড়। অন্যরা হলেন – মোরশেদ আলম, মমতাজ আলম, মোহাম্মদ আলম ও ফাতেমা বেগম। মুখতার হাটহাজারীতে বিয়ে করেছেন। বর্তমানে তিনি স্ত্রী ও চার কন্যাসন্তান নিয়ে সৌদি আরবের মক্কায় বসবাস করছেন। প্রায় এক বছর আগে গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন মুখতার।
মুখতার আলমের মামাতো ভাই মো: খালেদ ও মো: ইব্রাহিম জানান, মুখতার আলম ছোটবেলা থেকে খুবই মেধাবী ছিলেন। তখন থেকেই সৌদি আরবে থাকতেন তারা। মক্কার পবিত্র কাবাঘরের গিলাফ (কিসওয়াহ) প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের প্রধান ক্যালিগ্রাফার হিসেবে সে দেশের সরকার তাকে নাগরিকত্ব দিয়েছেন – এ খবর স্বজনরাও জেনেছেন সংবাদ মাধ্যম থেকে।
তারা বলেন, ‘মুখতারের এ অর্জনে আমরা সবাই খুবই আনন্দিত। তিনি লোহাগাড়া উপজেলাসহ সারাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন।’
স্বজনরা জানান, মুখতার আলমের পিতা প্রথমে চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদরাসায় শিক্ষকতা করেছেন। কিছুদিন পর তিনি সপরিবারে সৌদি আরব চলে যান। সেখানে দীর্ঘসময় সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ফার্মাসিস্ট হিসেবে বিভিন্ন হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেছেন। মূলতঃ পিতার কর্মসূত্রে পরিবারের সকলে দীর্ঘ সময় সৌদিতে কাটিয়েছেন।
স্থানীয় ইউপি সদস্য ফরিদ আহমদ জানান, এলাকার ছেলে সৌদি আরবের নাগরিকত্ব পাওয়ায় আমরা খুবই খুশি, গর্বিত। আশা করি তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সৌদিসহ বহির্বিশ্বে দেশের সুনাম আরো বৃদ্ধি পাবে।
সৌদি গেজেটের এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, মুখতার আলম বর্তমানে মক্কার কিসওয়া কারখানায় পবিত্র কাবার কিসওয়ার প্রধান ক্যালিগ্রাফার হিসেবে কাজ করছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী ও ফোরামে তার বিশেষ বিশেষ ক্যালিগ্রাফিগুলো প্রদর্শিত হয়েছে। ক্যালিগ্রাফি দক্ষতা বিষয়ক প্রশিক্ষণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ পাঠদান করেন। মক্কার দ্য ইনস্টিটিউট অব হলি মসক্ তথা পবিত্র মসজিদুল হারাম পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে ক্যালিগ্রাফি বিষয়ক তার লেসন শোখানো হচ্ছে।
তথ্য অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, মুখতার আলম ১৯৭৭ সালে পবিত্র কোরআন হিফজ সম্পন্ন করেন। ১৯৯২ সালে মক্কার বিখ্যাত উম্মুল কোরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিল্পকলা বিষয়ে স্নাতক ও ২০০১ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তিনি পিএইচডি গবেষণারত।
১৯৯৫ সাল থেকে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পকলা বিষয়ে শিক্ষকতা করেন। ২০০২ সাল থেকে পবিত্র কাবা ঘরের গিলাফ (কিসওয়াহ) প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। দীর্ঘ ৪০ বছর যাবত তিনি আরবি ক্যালিগ্রাফি পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন।
এছাড়া তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমা, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের সার্টিফিকেটের ক্যালিগ্রাফার হিসেবেও কাজ করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন সংস্থা থেকে অসংখ্য পুরস্কার ও প্রশংসার স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি।
প্রসঙ্গত, মুখতার আলম তার পূর্বসূরী আবদুর রহিম বোখারির স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। তিনি ১৯৯৬ সালে ৯০ বছর বয়সে মারা যান। মুখতার আলম ১৯৭৮ সালে গ্রান্ড মসজিদের ক্যালিগ্রাফি স্কুলে (চতুর্থ শ্রেণীতে) ভর্তি হন। সেখানে তিনি দু’বছর পড়াশোনা করেন।
সূত্র: নয়া দিগন্ত