ডায়াবেটিস হচ্ছে এমন এক রোগ যেটা আপনার শরীরে রক্তে গ্লুকোজের পরিমান বৃদ্ধির কারণে হয়ে থাকে। খাবার খাওয়ার পরে শরীরে যাওয়া বেশির ভাগ খাদ্য গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয়, তখন সে খাদ্য শরীরের বিভিন্ন কোষ এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পৌঁছে শক্তি প্রদান করতে ইনসুলিন নামক এক হরমোনের সাহায্য নেয় যা অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত হয়।
কিন্তু যদি কোনো কারণে ইনসুলিন সঠিকভাবে কাজ না করে কিংবা পরিমাণ মতো উৎপন্ন না হয় সেক্ষেত্রে রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। আর একেই আমরা ডায়াবেটিস বলে থাকি।
ডায়াবেটিসের কিছু প্রকারের মধ্যে টাইপ-১ ডায়াবেটিস এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিস হচ্ছে দীর্ঘকাল স্থায়ী এবং মারাত্মক।
সাধারণত টাইপ-১ ডায়াবেটিস হওয়ার কারণ হিসেবে জিনগত সমস্যাকেই দায়ী করা হয় বেশিরভাগ সময়ে। তবে অতিরিক্ত মেদ-ভুড়ি, স্থূলতা, শারীরিক পরিশ্রম, ধূমপান, বার্ধক্য কিংবা কোলেস্টেরল এর অতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হয়ে থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যনুযায়ী, ২০১৪ সালে প্রায় ৪২২ মিলিয়ন অর্থাৎ ৪২.২ কোটি মানুষের ডায়াবেটিস আক্রান্ত এবং ২০১৯ সালে এটাকে মৃত্যুের নবম প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়, আনুমানিক ১৫ লক্ষ মৃত্যুের সরাসরি কারণ ডায়াবেটিস। বাংলাদেশেও প্রায় ৮৫ লক্ষ মানুষ ডায়াবেটিসের সাহচার্যে রয়েছে।
অন্ধত্ব, কিডনি ফেইলিউর, হার্ট এটাক এবং স্ট্রোক এর অন্যতম প্রধান কারণ ডায়াবেটিস। এছাড়াও অবসাদ, শুষ্কত্বক, ত্বক ফেটে যাওয়া, অগ্ন্যাশয়ের কার্যক্ষমতা ঠিকভাবে না হওয়া ইত্যাদি ডায়াবেটিসের ফলস্বরূপ।
তবে হ্যা অল্প কিছু পরিবর্তন এবং সঠিক খাদ্যে ও পুষ্টির মাধ্যমে ডায়াবেটিসের সাথে সম্পর্কের অবন্নতি ঘটানো সম্ভবঃ
যেহেতু রক্তে গ্লুকোজের বৃদ্ধি ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী, সেজন্য প্রথমেই কম শর্করা আছে এমন খাদ্য বেছে নেয়া উচিত। যেমনঃ হোলগ্রেইন ফুড ( লাল চালের ভাত, বাসমতি চাল,লাল আটার রুটি, পাস্তা, কিনোয়া, বার্লি কিংবা ভুট্টা জাতীয় খাদ্য। )
এছাড়াও শাকসবজির মধ্যে রয়েছে গাজর, মাশরুম, শশা, বাধাকপি, ফুলকপি, ব্রকলি, লেটুস, বেগুন, টমেটো, সবুজ মটরশুটি, বিভিন্ন ডাটাজাতীয় শাক, মিষ্টি আলু, পেয়াজ, রসুন প্রভৃতি।
ফলের মধ্যে আপেল, পরিপক্ব হচ্ছে এমন কলা, কমলালেবু, নারিকেল, নাশপতি, বরই, জাম্বুরা, জামজাতীয় ফল, স্ট্রবেরি এমন ফল এবং বিভিন্ন রঙ-বেরঙের ফল। প্রয়োজনীয় শর্করার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের চাহিদাও পূরণ করবে ।
ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে আমিষজাতীয় খাবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সেজন্য পর্যাপ্ত আমিষ খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে। মুরগির মাংস, ডিম, অল্প চর্বিযুক্ত দুধ, টক দই, দেশজ মাছ, এছাড়া বিভিন্ন ডাল ও বীজ এবং মাংসের পরিবর্তে চাইলে সয়া এবং সয়াজাতীয় ( টফু, সয়াবিন, সয়ামিল্ক ইত্যাদি) খাদ্য, এদের মধ্যে যেকোনো কিছুই নিজের পছন্দ মতো পরিবর্তন করে গ্রহণ করা যাবে।
এরপরে স্বাস্থ্যকর ফ্যাটের জন্য সামুদ্রিক মাছ, বাদাম ( চিনাবাদাম, কাঠাবাদাম ), অলিভ অয়েল, ক্যানোলা অয়েল, বীজ যেমন তিসি, কুমড়া, সূর্যমুখী এসব ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্যে করে থাকে।
এর পাশাপাশি আরও কিছুদিকে নজর রাখা উচিতঃ
★ আঁশ তথা ফাইবারযুক্ত খাবার প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় যত বেশি থাকবে ততই ভালো।
★ অতিরিক্ত চিনিযুক্ত, লবনযুক্ত (৬ গ্রাম এর বেশি নয়),অতিরিক্ত মশলা ও তেল জাতীয় খাদ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এবং লাল মাংস এসব খাদ্য তালিকা থেকে যত কমিয়ে দেয়া যাবে, ডায়াবেটিস ততটাই নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
★ অবশ্যই নিয়মিত সকাল, দুপুর এবং রাতের খাবার খেতে হবে।
★ সপ্তাহে অন্তত আড়াই ঘন্টা দ্রুত হাটা, জগিং/ দৌড়ানো, সিড়ি বেয়ে ওঠা, সাইকেলিং করার মাধ্যমে শরীরচর্চা করতে হবে, যা রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখবে।
★ অবশ্যই মানসিক চাপ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হবে।
সর্বোপরি, এই কিছু জিনিস যেমন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে, তেমনি কোলেস্টেরল, সুস্থ হার্ট এবং দেহের অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা রাখে।
আমরা সবাই জানি, ডায়াবেটিস এখন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছে, খুব কম পরিবারই হবে যাদের বাসায় একজন ডায়াবেটিসের রোগী নেই। এতো দৌড়, ব্যস্ততার মাঝে আমরা কখন যেনো নিজেকে সময় দিতে ভুলেই যাই, আর ওই সুযোগেই বিভিন্ন রোগ-বালাই হানা দিয়ে বসে। সবাই কমবেশি নিশ্চয়ই জানি ডায়াবেটিস আক্রান্ত হলে দেহের জন্য এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে জীবনে কতটা প্রভাব আসে। তাইলে জীবনে যদি সুস্থতাই না থাকে তাহলে এতো দৌড় কোন উদ্দেশ্যে?
তাই সুস্থ থাকুন, অন্যেকে সুস্থ রাখুন। একমাত্র সুস্থতাই পারে মানুষকে সতেজ ও সুন্দর রাখতে।
তথ্যসূত্র: cdc.com, healthline, who.int, medlineplus.gov, mayoclinic, livestrong.com, shohay.health, prothom alo
লেখক:
সৌরভ চন্দ্র দেবনাথ (অফিসিয়াল ভলান্টিয়ার, নিউট্রিপ্রেনার বাংলাদেশ)