জাতীয় সংসদ বহাল রেখে আগামী জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না বলে মনে করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম। এ সময় তিনি জাতীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানান।
রোববার (১৮ জুন) দুপুর সোয়া ১২টায় রাজধানীর পুরানা পল্টনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি জানান তিনি।
বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের মেয়র প্রার্থী মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিমসহ নেতাকর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে এই সংবাদ সম্মেলন করে দলটি। এসময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) পদত্যাগ এবং জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির বলেন, ক্ষমতাসীনরা এবারও জাতীয় সংসদ বহাল রেখে গায়ের জোরে তাদের অধীনেই একটি নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচন করতে চায়। কিন্তু জাতীয় সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে না। বরং আবারও ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো নির্বাচনের নামে প্রহসন হবে।
তিনি বলেন, এই সংসদ বহাল রেখে কোনো নির্বাচন দেশবাসী মেনে নেবে না। তাই আমরা বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন চাই।
আওয়ামী লীগ সরকার দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করে ফেলেছে দাবি করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির বলেন, বিগত প্রায় ১৪ বছর দেশে কোনো সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়নি। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতেও জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেনি। ক্ষমতাসীনরা তাদের দলীয় লোকদের নির্বাচিত করার জন্যে এমন কাজ নেই যা করেনি। নির্লজ্জভাবে মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসন কেউই নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেনি। ফলে নির্বাচনকে মানুষ এখন প্রহসন এবং তামাশা মনে করে। আগামীতে মানুষ আর তামাশা ও প্রহসনের নির্বাচন দেখতে চায় না।
তিনি বলেন, দেশের মানুষ আজ আতঙ্কিত, ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। দেশে সংঘাত আর সহিংসতার অশনি সংকেত পাওয়া যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নবম জাতীয় সংসদে এক তরফাভাবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করার পর থেকেই রাজনৈতিক সংকটে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। আমরা বারবার রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের দাবি জানিয়ে আসছি। দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা সংকট সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলে আসলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবেন না ঘোষণা দিয়ে সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, বর্তমান বিতর্কিত সরকারের ক্ষমতার মেয়াদ প্রায় শেষ প্রান্তে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সরকারের পরিবর্তন হতে হলে, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন লাগবে। আমরা চাই একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতার পালা বদল হোক। কিন্তু আগামী জাতীয় নির্বাচন কীভাবে হবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনে করে, বৈধ এবং শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা পরিবর্তনের মাধ্যম হলো নির্বাচন। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের অভিপ্রায়ের যথার্থ বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তাই আমরা দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবো না।
তিনি বলেন, আমরা অচিরেই অন্যান্য প্রতিনিধিত্বশীল, দেশপ্রেমিক, রাজনৈতিক দল এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারের বিস্তৃত রূপরেখা ঘোষণা করবো। আগামী দিনে দেশে শান্তি বজায় রাখার জন্যে এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা বদলের লক্ষ্যে আজ আমরা মৌলিকভাবে কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরছি।
এসময় তিনি কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরেন-
১. জাতীয় সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে।
২. জাতীয় সরকার গঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বর্তমান জাতীয় সংসদ ভেঙে দিতে হবে।
৩. সংসদ ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
৪. জাতীয় সরকার গঠিত হওয়ার পরবর্তী ৩ মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করবে। কোনো কারণে তা সম্ভব না হলে পরবর্তী ৩ মাসের মধ্যে অবশ্যই নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
৫. বর্তমান মন্ত্রীসভার কেউই নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারে থাকতে পারবেন না। জাতীয় সরকারে যারা থাকবেন তারা জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারে কারা থাকবেন এ বিষয়ে দলটির মতামত তুলে ধরা হয়। এ বিষয়ে তিনি জানান, জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনরত রাজনৈতিক দল, দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী মহল এবং সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুতই আমরা জাতীয় সরকারে কারা থাকবেন এবং সরকার কাঠামো কী হবে তা প্রকাশ করবো।
এ সময় বেশ কিছু দাবিও তুলে ধরেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির। সেগুলো হলো-
১. যেকোন মূল্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে হবে। বাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে। লোডশেডিংথেকে জাতীকে মুক্তি দিতে হবে।
২. অবিলম্বে বিনা বিচারে দীর্ঘদিন ধরে কারাবন্দি সব আলেম এবং রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে।
৩. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, জাতীয় সংহতি ও কার্যকর সংসদ প্রতিষ্ঠায় জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে।
৪. বরিশালে মুফতি ফয়জুল করীমের ওপর হামলাকারী এবং এ ঘটনার পেছনে যারা রয়েছে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে তাদের চিহ্নিত করতে হবে।
৫. গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে প্রণীত বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে।
৬. সব রাজনৈতিক দলের জন্য সভা-সমাবেশসহ সাংবিধান স্বীকৃত সব রাজনৈতিক কর্মসূচি ও বাকস্বাধীনতা উন্মুক্ত করতে হবে।
৭. সরকারের নির্বাহী আদেশে বন্ধ সব টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্র অবিলম্বে চালু করতে হবে।
৮. সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডসহ সব সাংবাদিক হত্যার দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
এস.আই/