আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায় ধর্মভীরু। এই জনপদের প্রতিটি মুসলমান ইসলামের প্রতি গভীর ভালোবাসা লালন করেন। এখানকার সবাই হয়তো প্রাক্টিসিং মুসলমান নন; কিন্তু কুরআন কিংবা রাসূল সা: অথবা ইসলামের কোনো বিধানের অবমাননা হলে এই মানুষগুলোই ক্ষোভে ফুঁঁসে ওঠেন, প্রতিবাদে নেমে আসেন রাজপথে। এটি তাদের সুপ্ত ঈমান ও ইসলামপ্রীতির পরিচয়।
যে দেশের সাধারণ জনগণের রক্তকণিকায় ইসলামপ্রেম বহমান, প্রত্যহ ভোরে যাদের ঘুম ভাঙে আজানের সুমধুর ধ্বনিতে, সেই দেশের কোমলমতি শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে ইসলামের ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য প্রতিফলিত হবে এটিই ছিল স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত ঘটনা। অথচ অত্যন্ত মর্মান্তিক ও বেদনার বিষয় হলো- নতুন বছরের পাঠ্যবইয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি।
এ দেশের হিন্দু-মুসলিম সব অভিজাত নারী পর্দা ও শালীনতার ঐতিহ্য বহন করে চলেন আপন শরীরে। এ দেশের কোনো বধূ কিংবা মায়ের মুখ কল্পনা করতে গেলে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঘোমটা টানা নারীর মুখচ্ছবি। এটিই এ দেশের নারীর চিরায়ত পরিচয়। অথচ এই দেশের সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ে অবরোধবাসিনী গল্পে (পৃষ্ঠা-১২১) নারীর শালীনতা ও পর্দাকে তীব্রভাবে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। এ দেশের কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষের হৃদয়কে রক্তাক্ত ও ক্ষুব্ধ করেছে এই গল্প, যে ক্ষোভের কিছু আভাস আমরা ইতোমধ্যে সোস্যাল মিডিয়ায় দেখতে পেয়েছি।
আমরা নারীর শিক্ষা ও প্রগতির বিরোধী নই। পর্দা পালনের পরও যে নারীরা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়ার কাণ্ডারি হতে পারেন, তার অসংখ্য উদাহরণ আমাদের চার পাশে আছে। তবু কেন পর্দাকেই অগ্রগতির অন্তরায় ভাবা হবে? আমরা জানি না, যে শিক্ষিকা বোরকা পরে পাঠদান করেন, তিনি সন্তানপ্রতিম শিক্ষার্থীদের অবরোধবাসিনীর এই গল্প কিভাবে পড়ে শোনাবেন! এই গল্প শিক্ষার্থীদের বোরকা পরা আপন মা ও শিক্ষিকার পোশাককে অশ্রদ্ধা করতে শেখাবে। এর ফলে তৈরি হবে অস্থিরতা, নেমে আসবে তীব্র সামাজিক বিপর্যয়, গড়ে উঠবে শেকড়কে অশ্রদ্ধা করা একটি উচ্ছৃঙ্খল প্রজন্ম। আমাদের ধর্ম, সমাজ ও কৃষ্টিবিরোধী এই গল্পের বিকল্প অনুসন্ধানের জন্য আমরা কর্তৃপক্ষকে সবিনয় অনুরোধ করছি।
এখানেই শেষ নয়। নতুন পাঠ্যবইয়ে একপেশে ইতিহাস বর্ণনা, মুসলিম শাসকদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন, ইসলামের সিম্বলকে হেয় করা, মুসলিম সংস্কৃতি এড়িয়ে যাওয়াসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসবিরোধী বিতর্কিত বৈজ্ঞানিক থিওরি উপস্থাপনের অভিযোগ উঠেছে। পাঠ্যবইয়ে ইসলামী বিশ্বাস ও ঐতিহ্যবিরোধী এ ধরনের কয়েকটি বিষয়, যা এ দেশের ধর্মপ্রাণ জনসাধারণকে তীব্রভাবে আহত করেছে, নিম্নে তা উপস্থাপন করা হলো-
– সপ্তম শ্রেণীর ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন’ বইয়ের ৫ নম্বর পৃষ্ঠায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ, দুদু মিয়া ও ফকির মজনু শাহের নাম। উল্লেখ করা হয়নি তাদের আন্দোলনের নাম এবং দেয়া হয়নি তাদের অবদানের স্বীকৃতি। বিপরীতে নানকার, টঙ্ক, স্বদেশী আন্দোলন, নীল বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ এবং ইলামিত্র ও প্রীতিলতাদের অবদান তুলে ধরা হয়েছে। এ দেশের মুসলিম শিশুরা ইলামিত্র, প্রীতিলতার নাম পড়ে বড় হবে অথচ তিতুমীরের নামটি পর্যন্ত তারা শুনবে না, সন্তানের বাবা হিসেবে এ আমরা কল্পনাও করতে পারি না। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে আমরা হিন্দুদের অবদানকে অস্বীকার করি না। তাদের ইতিহাস অবশ্যই থাকুক পাঠ্যবইয়ে; কিন্তু মুসলমানদের অবদান কেন অনুল্লেখ থাকবে? এটি কি ইতিহাস ও সত্যের প্রতি অবিচার নয়?
– এই বাংলায় ইসলাম এসেছে বখতিয়ার খিলজির মাধ্যমে। এ দেশের মানুষ বখতিয়ারকে নিপীড়িত জনতার ত্রাণকর্তা হিসেবে বিশ্বাস করে; কিন্তু সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের ৩ নম্বর পৃষ্ঠায় বখতিয়ারকে দখলদার, বেশ কয়েকটি পাঠাগার ধ্বংসকারী খলনায়ক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অথচ রমেশচন্দ্র মজুমদার তার বিখ্যাত ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, বখতিয়ার খিলজি ভুল তথ্যের ভিত্তিতে দুর্গ মনে করে একটি বিহার আক্রমণ করেন, বেশ কয়েকটি নয়। তা ছাড়া নালন্দায় বখতিয়ার আক্রমণ করেছিলেন কি না তা নিয়ে ভারতের পার্লামেন্টে ২০১৪ সালে একটি বিতর্ক হয়। কংগ্রেসের করণ সিং আক্রমণের জন্য বখতিয়ারকে দায়ী করেন। সিপিএমের সীতারাম করণ সিংয়ের দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। সীতারাম দৃঢ় কণ্ঠে জানান, বখতিয়ারের নালন্দা আক্রমণের কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। ভারতে যা অপ্রতিষ্ঠিত, বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে তা প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
– ষষ্ঠ শ্রেণীর ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন’ বইয়ের ১৭ পৃষ্ঠায় বেশ কয়েকবার দাড়ি নিয়ে ঠাট্টামূলক বাক্য লেখা হয়েছে। এই বাক্যগুলো পড়লে যেকোনো ধর্মপ্রাণ মুসলমান স্তম্ভিত হতে বাধ্য। যেসব সম্মানিত শিক্ষক এই বই পড়াবেন, তাদের অনেকের মুখে দাড়ি আছে। আবার যে কোমলমতি শিশুরা এই বই পড়বে তাদের বেশির ভাগের বাবা এবং প্রায় প্রত্যেকের দাদা-নানার মুখে সুন্নতি দাড়ি আছে। অভিভাবক হিসেবে এই বই সন্তানদের পড়াতে গিয়ে আমরা কি বিব্রত হবো না?
– ট্রান্সজেন্ডার শেখানোর নামে কোমলমতি শিশুদের সামনে রহস্যময় নিষিদ্ধ জগতের দুয়ার খুলে দেয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর মাধ্যমে সমকামিতার মতো রাষ্ট্র ও সভ্যতাবিরোধী অপকর্ম স্বাভাবিক ও সহজলভ্য হয়ে উঠবে, যা এই জনপদের হিন্দু-মুসলিম সবার জন্য আক্ষরিক অর্থেই অভিশাপ হয়ে দেখা দেবে।
– চার্লস ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব একটি বিতর্কিত মতবাদ। বেশির ভাগ বিজ্ঞানী ডারউইনের এই মতবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এত দিন ইসলাম ও প্রকৃতিবিরোধী বিতর্কিত এই মতবাদ নবম-দশম শ্রেণীতে পড়ানো হলেও এ দেশের ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠী ও সচেতন আলেমসমাজ এ বিষয়ে কথা বলেনি। কারণ নবম-দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা ভালোমন্দ নির্ণয়ের মোটামুটি ক্ষমতা রাখে; কিন্তু কুরআনের সাথে সঙ্ঘাতপূর্ণ বিতর্কিত এই মতবাদ কেন ষষ্ঠ শ্রেণীর অবুঝ শিশুদের সামনে উপস্থাপন করা হবে? কুরআনবিরোধী একটি প্রজন্ম গড়ে তোলাই কি মূল লক্ষ্য?
– নতুন বছরের নতুন বইয়ের প্রচ্ছদেও আমাদের ধর্ম-সমাজ-সংস্কৃতি ও আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের প্রচ্ছদে দেয়া হয়েছে মৌর্য আমলের বৌদ্ধসমাজের পাটলিপুত্র মন্দিরের ছবি। এটি না আমাদের দেশের ইতিহাসের প্রতিনিধিত্ব করে, না আমাদের ধর্মের। প্রচ্ছদের ময়ূর, পদ্ম ফুল, জবা ইত্যাদি আমাদের জাতীয় পাখি বা ফুলও নয়। ২০২২ সালে আলিয়া মাদরাসার প্রথম শ্রেণীর ইংরেজি বইয়ের প্রচ্ছদে ছিল টুপি ও হিজাব পরিহিত বালক-বালিকার ছবি। এ বছরের নতুন বইয়ে বালকের মাথা থেকে টুপি ও বালিকার মাথা থেকে হিজাব সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আবার সপ্তম শ্রেণীর সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ব্যবহার করা হয়েছে প্রায় ২০০টি ছবি। অবাক করা বিষয় হলো- ১৮টি মন্দির-প্যাগোডার ছবির বিপরীতে মসজিদের ছবি এসেছে মাত্র তিনটি।
– প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে ইসলাম ও কৃষ্টিবিরোধী এ রকম অসংখ্য অনুষঙ্গ নতুন পাঠ্যবইয়ের পাতায় পাতায় ঢোকানো হয়েছে। এ ঘটনায় প্রতিটি মুসলমান ব্যথিত ও রক্তাক্ত হয়েছে। এটি যে দুর্ঘটনাবশত আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়; বরং পরিকল্পিত, উদ্দেশ্যমূলক ও ধর্মবিদ্বেষ থেকে সংঘটিত হয়েছে, বিকৃতির সংখ্যাধিক্যই তার প্রমাণ বহন করে।
প্রতিকার ও প্রস্তাবনা :
১. পাঠ্যপুস্তক রচনা ও সম্পাদনার দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের ব্যাপারে যথাযথ তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেয়া হোক।
২. পাঠ্যপুস্তক রচনা ও সম্পাদনায় যোগ্য, অভিজ্ঞ, নীতিবান, ইসলামবিদ্বেষী নন এবং যারা আমজনতার ভাষা পড়তে পারেন, এমন বিচক্ষণ সংবেদনশীল মানুষকে নিয়োগ দেয়া হোক। পাশাপাশি সম্পাদনা প্যানেলে আলেমসমাজের প্রতিনিধি হিসেবে বায়তুল মোকাররমের খতিব, হাইআতুল উলয়ার চেয়ারম্যান অথবা তাদের পর্যায়ের কাউকে রাখা হোক।
৩. ইসলাম ও সব ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক এবং বহু বিজ্ঞানী কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত ও বিতর্কিত বিবর্তন মতবাদকে পাঠ্যপুস্তক থেকে অপসারণ করা হোক কিংবা এটি একটি মত হিসেবে উল্লেখ করা হোক।
৪. দাড়ি-টুপি-পর্দাসহ যেকোনো ধর্মের ধর্মীয় অনুষঙ্গকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে এমন বিষয় পরিহার করা হোক।
৫. মুসলিম শাসনামলের শুধু নেতিবাচক দিক উল্লেখ না করে তাদের ইতিবাচক দিকগুলোও উল্লেখ করা হোক।
৬. অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর পাশাপাশি ভারতবর্ষ স্বাধীন করার ব্যাপারে মুসলমানদের আন্দোলন ও অবদানের ইতিহাস তুলে ধরা হোক।
৭. বইয়ের প্রচ্ছদে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী বিষয়কে অগ্রাধিকার দেয়া হোক।
৮. সমকামিতাসহ দেশের আইনে নিষিদ্ধ এমন বিষয় পাঠ্যপুস্তক থেকে অপসারণ করা হোক।
৯. মাদরাসার পাঠ্যবইয়ের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা হোক। মাদরাসার পাঠ্যবইয়ের প্রচ্ছদে ইসলামের প্রতিনিধিত্বকারী অনুষঙ্গ ফিরিয়ে আনা হোক এবং বিশেষত ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো মতবাদ ও বিষয় থেকে মাদরাসার পাঠ্যবইকে বিযুক্ত রাখা হোক।
১০. পাঠ্যবইয়ে দেশের সাধারণ জনগণের কৃষ্টি, কালচার ও ঐতিহ্যকে প্রাধান্য দেয়া হোক। সাম্প্রাদায়িক শান্তি বিনষ্টকারী উসকানিমূলক বিষয় পরিহার করা হোক।
পরিশেষে, এ দেশের শিক্ষাবিদ, সমাজতাত্ত্বিক, বিজ্ঞ আলেম, সোস্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্টরা নতুন প্রণীত পাঠ্যবই সম্পর্কে যে অভিযোগগুলো তুলেছেন, তা গুরুত্বের সাথে দেখার এবং যাচাই-বাছাইপূর্বক সংস্কার করার সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, পাঠ্যবই নিয়ে সচেতন নাগরিক সমাজ যে আলোচনা-সমালোচনা করছে, ব্যথিত হৃদয়ে জনতার মধ্যে তারা যে বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন, তা এ দেশের আমজনতারই কণ্ঠস্বর। এই কণ্ঠস্বরকে যদি অবহেলা করা হয় তবে এ দেশের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা শিক্ষাব্যবস্থার ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলবে, যা হবে সোনার বাংলার জন্য কলঙ্কের ঘটনা। প্রিয় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার গায়ে কলঙ্কের কালি লাগুক তা আমরা কেউ-ই চাই না। সূত্র: নয়া দিগন্ত