জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদ্বোধন হয় এবারের কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলের। যেখানে সংক্ষিপ্ত সময়ের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে নানা বিষয়।
কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে পুরো বিশ্ব অবাক হয় যখন এবারের আয়োজনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শুরু হয় কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে। মুসলিম বিশ্বের আহবানে পুরো বিশ্ববাসির জন্য এ এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করলো কাতার।
এর মধ্যেও অন্য একজন এবারের বিশ্বকাপে সবার দৃষ্টি কাড়েন। তিনি গনিম-আল-মুফতাহ্, তাঁর হাত ধরেই বেজে উঠলো এবারের ফিফা বিশ্বকাপের দামামা। পা-হীন এই মুফতাহ কে, কি তার পরিচয় ? আসুন জেনে নেই।
_1669015586.jpeg)
বর্তমান কাতারের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত এবং বিখ্যাত একজন ব্যাক্তি হলেন এই গনিম-আল-মুফতাহ্। যিনি ২০২২ সালের বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসরের উদ্বোধন করলেন। আর এর মধ্য দিয়েই বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে গেলেন কাতারের এই দূত।
বাংলাদেশ সময় রাত ৮টা ৪০ মিনিটে কাউন্ট ডাউনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় কাতার বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো ও কাতার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রধানের আগমনের পরই শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা।
কে এই মুফতাহ?
মুফতাহ মূলত একজন বিশ্ববিখ্যাত মোটিভেশনাল স্পীকার। তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে উজ্জীবিত, বর্ণময় হয়ে ওঠে হাজার বর্ণহীন জীবন। গারসিয়া আইসক্রিম নামের একটি নিজস্ব কোম্পানি আছে মুফতাহর। কাতারে আছে এর ছয়টি কারখানা। এছাড়া তিনি একজন কবি, সাহিত্যিক, দারুণ বক্তা হিসাবে আরব দুনিয়া তথা গোটা বিশ্বের কাছে সমাদৃত। তিনি স্বপ্ন দেখেন একদিন প্যারা অলিম্পিকে খেলার। গোটা কাতার তথা আরব দুনিয়ার একজন রোল মডেল তিনি।
২০১৮ সালে টেড এক্স কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে একটি বক্তৃতার মাধ্যমে আলোচনায় আসেন মুফতাহ। পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক পরিচিতি পান তিনি। ইনস্টাগ্রামে এক মিলিয়নেরও বেশি অনুসারী আছে মুফতাহর। আরবের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর লাখো ভক্ত-সমর্থক।
শিশুকাল থেকে নানাভাবে সামাজিক বঞ্চনার শিকার হন তিনি। স্কুল, খেলার মাঠ সহ বিভিন্ন জায়গায় তাঁকে অপমানিত হতে হতো। তিনি এসবের তোয়াক্কা না করেই এগিয়ে যেতেন নিজ পথে, একেবারে নিজস্ব ছন্দে। বন্ধুদের বোঝাতেন-তাঁর অসম্পূর্ণ শরীরের জন্য তিনি মোটেও দোষী নন। আল্লাহ তাঁকে যে পরিমাণ অঙ্গ-প্রতঙ্গ প্রদান করে পাঠিয়েছেন, এর জন্য তিনি কৃতজ্ঞ।
নিজের সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব-চারপাশকে বোঝাতে বোঝাতে নিজের অজান্তেই একসময় তিনি হয়ে ওঠেন একজন মোটিভেশনাল স্পীকার।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
৫ই মে ২০০২ সালে পৃথিবীতে আসেন গনিম। গনিম-আল-মুফতাহ্-এর শরীরের নিচের অংশ নেই, জন্মের আগেই দুটো পা হারিয়ে ফেলেন। ‘কোডাল রিগ্রেশন সিনড্রোম’ রোগে আক্রান্ত গনিমের শরীরের নিম্নাংশ না থাকা সত্বেও তিনি এগিয়ে গেছেন।
গনিম যখন মাতৃগর্ভে, তখনই ধরা পড়ে তাঁর শরীরের অবিকশিত অংশ। এসব দেখে ডাক্তার তার বাবা-মাকে গর্ভপাত করানোর পরামর্শ দেন। কারণ, অপূর্ণাঙ্গ সন্তানের জন্ম দেওয়ার চেয়ে তাকে জঠরে হত্যা করে দেওয়াই শ্রেয় বলে মনে করেছিলেন চিকিৎসক।
গনিমের বাবা-মা এই সিন্ধান্ত মেনে নেন নি। কারণ, ইসলামে গর্ভপাত হলো চূড়ান্ত এক গর্হীত অপরাধ।
তার মাতা ইমান-উল-আবদেলি এবং পিতা মুহাম্মদ-আল-মুফতাহ্ এটাকে মহান আল্লাহর সিন্ধান্ত হিসেবে মেনে নিয়ে, বিকলাঙ্গ সন্তানের জন্ম দিলেন। তার বাবা তাকে উদ্দেশ্যে বলেন – আমি হবো সন্তানের বাম পা আর তুমি(মা) হবে তার ডান পা। আমরা দুজনে সন্তানকে কখনো নিম্নাংশের অভাব টের পেতে দেবো না। এমনটাই ছিল মুফতাহর জন্ম ইতিহাস।
জন্মের পরে ডাক্তাররা বলেছিলেন, ১৫ বছরের বেশি বাঁচার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ মিফতাহর। কিন্তু হাল ছাড়েননি মুফতাহ ও তার পরিবার।আর আজ তিনি বিশ্ব ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্ধ অংশ হয়ে রইলেন।
বিশ্ব দরবারে মুফতাহ
একদিন যাঁর ভুমিষ্ট হওয়া নিয়েই যথেষ্ট সন্দেহ ছিলো, তাঁর হাতে আজ উদ্বোধন হলো বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রতিযোগিতা কাতার ফুটবল বিশ্বকাপ-২০২২।
এবারের বিশ্বকাপের অ্যাম্বেসডর তিনি। এ নিয়ে এক বিবৃতিতে মুফতাহ বলেন, ‘অ্যাম্বাসেডর হিসেবে আমি আমার সক্ষমতা দিয়ে আশা, সামগ্রীকতা, শান্তি ও মানবতার জন্য ঐক্যবদ্ধতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে চাই। ’

২০ বছর বয়সী এই প্রতিবন্ধী যুবক আজ সে দেশের শান্তির দূত। গোটা বিশ্ব দরবারে পৌঁছে গেছেন বিশ্বকাপে তার বার্তা দিয়ে। আজ তিনি কাতার সরকারের প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের দরবারে নিজের ও দেশের পরিচিতি তুলে ধরলেন।
শত বাধা প্রতিবন্ধকতায়ও যে এগিয়ে যাওয়া যায়, তার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে রইলেন তিনি বিশ্বের বুকে।