জাভেদ রায়হান, কুবি প্রতিনিধিঃ গত কিছুদিন ধরে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এম. কাজী আনিছুল ইসলামের পদোন্নতি স্থগিত নিয়ে বেশ আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। এক সিন্ডিকেট সভায় তাকে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হলে অন্য সিন্ডিকেট সভায় তা স্থগিত করা হয়। অথচ তিনি সহকারী অধ্যাপক পদে যোগদান পত্র ও বেতন-ভাতা পেয়ে আসছিলেন।
হঠাৎ তার পদন্নোতি স্থগিত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষদের মনে জন্ম নিয়েছে নানা বিধ প্রশ্ন। এম. কাজী আনিছুল ইসলামের পদোন্নতি নিয়ে বিভাগের প্ল্যানিং কমিটিকে দায়ী করা হচ্ছে, কিন্তু আসলেই কি ব্যাপারটি তাই? বিষটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে বিস্তারিত লিখেছেন ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নাদিয়া সারোয়ার।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক, জনাব কাজী আনিসের সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি বিশ্ববিদ্যালয়টির সিন্ডিকেটের ৮০তম সভায় স্থগিত করার বিষয়টি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে. উল্লেখ্য যে, জনাব আনিস ঊনাশিতম তম সিন্ডিকেট সভায় প্রভাষক হতে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে প্রায় ছয় মাস যাবত সহকারী অধ্যাপক পদের সকল সুযোগ সুবিধা ও মর্যাদা পেয়ে আসছিলেন বিধায় হঠাৎ করে পদোন্নতির বিষয়টি স্থগিত হওয়ায় খুব স্বাভাবিকভাবেই সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মনে জন্ম নিয়েছে নানাবিধ প্রশ্ন ও সংশয় । আমি নিজেও বিষয়টি একটু পর্যালোচনা করে দেখার চেষ্টা করছি. পত্রপত্রিকার বিভিন্ন সংবাদ এর মাধ্যমে অবগত হলাম যে জনাব আনিসের থেকে সংগ্রহীত অভিজ্ঞতা সনদের “To forwarded” এর জায়গায় “To whom it may concern” লেখায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জনাব আনিসের পদোন্নতি সিন্ডিকেট এর আশিতম সভায় স্থগিত করে পদোন্নতি টি পুনরায় যাচাই- বাছাইয়ের জন্য বিভাগে প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় I এরপর থেকেই বিভিন্ন মহলে ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় ওঠে ।
এখন আসি চাকরির অভিজ্ঞতা সম্পর্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিটি আসলে কি? কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের আটষট্টিতম তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী- “চাকুরীরত প্রার্থীদের অবশ্যই যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে. আবেদনকারীর আবেদনপত্র সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এর রেজিস্টার/ প্রতিষ্ঠান প্রধান কর্তৃক কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার বরাবর ফরোয়ার্ডেড হতে হবে অথবা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সরবরাহকৃত মূল আবেদনপত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রধানের স্বাক্ষর ও সিল সমেত ফরওয়ার্ড বা অগ্রায়ন শব্দটি লেখা থাকলে তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আবেদন বলে বিবেচিত হবে”।
উক্ত সিদ্ধান্ত মোতাবেক জনাব আনিসের অভিজ্ঞতা সনদে “to forwarded” লিখাটা বাঞ্ছনীয় ছিল বিধায় তার ঊনাশিতম সিন্ডিকেট সভায় গৃহীত পদোন্নতি টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল হিসেবে আখ্যায়িত করে সিন্ডিকেটের আশিতম সভায় পদন্নতির বিষয়টি পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নেয় ।
এখন আসি এই অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল কে আসলে খুব স্বাভাবিকভাবে দেখার সুযোগ আছে কি না? এক্ষেত্রে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পদন্নতির কিছু ধাপ উল্লেখ করতে চাই I সাধারণত একজন শিক্ষক যখন পদন্নতির আবেদন করেন সেটা রেজিস্ট্রার অফিসে হতে সংশ্লিষ্ট বিভাগে প্রেরণ করা হয় I উক্ত বিভাগের প্লানিং কমিটি আবেদনপত্রটি পর্যালোচনা করে রেজিস্ট্রার অফিসে ফরওয়ার্ড করে । এখন প্রশ্ন হচ্ছে বিভাগের প্ল্যানিংয়ের পর্যালোচনায় অভিজ্ঞতা সনদের বিষয়টি কেন উঠে আসলো না এবং বিভাগ কেন আবেদনপত্রটি ফরওয়ার্ড করল? অবশ্যই বিভাগের প্ল্যানিং কমিটিতে বিষয়টি উঠে আসা উচিত ছিল । কিন্তু আমার জানামতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লানিং কমিটি গুলো সাধারণত যে কোনো আবেদন পত্র বিধি মোতাবেক পর্যালোচনার জন্য রেজিস্টার মহোদয়কে সুপারিশ করে. কোন ব্যক্তিকে পদোন্নতি দিতেই হবে এমনটা বলার প্লানিং এক্তিয়ার প্লানিং কমিটির নেই ।
এখন আসি প্লানিং কমিটি ভুল করলেও রেজিস্ট্রার অফিসের ভুল করাটা কতটা যৌক্তিক? আমার জানামতে একজন ব্যক্তির পদন্নতির আবেদনপত্রটি উক্ত পদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক সকল শর্ত পূরণ করে কিনা এ বিষয়টি দেখার সর্বোচ্চ দায়ভার রেজিস্ট্রার অফিসের উপরেই বর্তায় কারণ আবেদনকারীকে মৌখিক পরীক্ষায় আমন্ত্রণ জানানো হবে কিনা এটা রেজিস্ট্রার অফিসের আবেদন পত্র স্ক্রীনিং এর পরেই সিদ্ধান্ত হয় । একজন আবেদন করলেই তাকে মৌখিক পরীক্ষায় আমন্ত্রণ করতে হবে এমনটি নয়। আবেদনকারী ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী উক্ত পদের জন্য নূন্যতম যোগ্যতা পূরণ করে এই ব্যাপারটি নিশ্চিত হয়েই রেজিস্টার মহোদয় উক্ত ব্যক্তির মৌখিক পরীক্ষার আয়োজন করেন ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আটষট্টিতম তম সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্তটি নিশ্চয়ই রেজিস্ট্রার মহোদয়ের অজানা নয়? যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী জনাব আনিস এর আবেদনপত্রটি নূন্যতম যোগ্যতা পূরণ না করে তাহলে ব্যাপারটি মৌখিক পরীক্ষা পর্যন্ত কেন গড়ালো? পরবর্তীতে মৌখিক পরীক্ষা বা সিন্ডিকেট সভায় ও বিষয়টি দৃষ্টিগোচর না হওয়ায় জনাব আনিসকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই অনাকাঙ্খিত ভুলের দায়ভারটা আসলে কার? বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলেছে প্লানিং কমিটি ভুলের ধারাবাহিকতায় এ ভুল হয়ে আসছে কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে প্লানিং কমিটি আবেদনপত্র ফরোয়ার্ড করলেই কি রেজিস্টার মহোদয় অন্ধভাবে তা গ্রহণ করে নিবেন? তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় এ একজন রেজিস্ট্রারের কাজ কি? শিক্ষকদের পদোন্নতি আবেদনপত্র যাচাই বাছাই করে পরবর্তী ধাপে প্রেরণ করা বা না করা একজন রেজিস্ট্রারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব । জনাব আনিস এর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা কি রেজিস্টার মহোদয়ের দায়িত্বে অবহেলার পরিচয় দেয় না? এটা কি সত্যি অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল?, দায়িত্বে অবহেলা? নাকি খুবই পরিকল্পিতভাবে জনাব আনিসকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রয়াস?
আমি ধরে নিলাম এটা অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল. এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই ভুলের মাশুল কেন জনাব আনিস দিবেন? একজন ব্যক্তি পদন্নতির আবেদন করতেই পারেন এবং পদোন্নতি দিতেই হবে এমনটা দাবি করতেও জনাব আনিস কে শোনা যায়নি । তাহলে পুরো প্রক্রিয়ায় যদি তার কোনো দোষ না থাকে এবং ব্যাপারটি যদি প্রশাসনের ভুলের কারণে ঘটে তাহলে আসলে কি করা উচিত ছিল? হয়তো অনেক কিছুই করা যেত! আমি শুধু আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে আসা একটি উপায় বলছি. বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে খুব সহজেই জনাব আনিসকে যথাযথ অভিজ্ঞতা সনদ জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া যেতে পারত এবং সেই অভিজ্ঞতার সনদ বিধি মোতাবেক প্রেরণ সাপেক্ষে ভূতাপেক্ষভাবে অগ্রায়নের মাধ্যমে পদোন্নতিটি বহাল রাখার ব্যবস্থা করা যেত ।
এমন কিন্তু না যে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ভূতাপেক্ষভাবে অগ্রায়নের ঘটনা এর আগে ঘটেনি । এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্বে ও বিশেষ ব্যক্তি বর্গের স্বার্থে অনেক কঠিন বিষয়ের ও সহজ সমাধান বের কর করা হয়েছে । এখন প্রশ্ন হচ্ছে নিজেদের ভুল থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেন এমন কোন সহজ সমীকরণ অনুসরণ না করে জনাব আনিস এর পদোন্নতি স্থগিত করে পুনরায় একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিল? আমার জানামতে রেজিস্টার মহোদয় আজ পর্যন্ত এই অনাকাঙ্খিত ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ পর্যন্ত করেননি! একজন শিক্ষক হিসেবে এটাই কি তাহলে জনাব আনিসের প্রাপ্য? তিনি একজন সাধারণ শিক্ষক এবং কোন বড় পদ-পদবিতে নেই বলে কি উনার আত্মমর্যাদা, সময়ও কষ্টের কোন মূল্য নেই? একজন শিক্ষককে পদোন্নতি ও সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হল এবং পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভুল প্রতীয়মান হওয়ায় তার পদোন্নতি স্থগিত করে পুনরায় একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য করা কি একজন শিক্ষকের জন্য যথেষ্ট অপমানজনক, সম্মানহানিকর ও বিরম্বনার বিষয় নয়?
মজার ব্যাপার হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিন্তু জনাব আনিসের অভিজ্ঞতার সত্যতা নিয়ে কোনো সংশয় প্রকাশ করেনি! যেহেতু প্রশাসনিক একটি ভুল হয়েই গেছে বলে প্রশাসন দাবি করছে তাহলে “to forwarded” আর “To whom it may concern’ এর মধ্যকার শাব্দিক এই ব্ব্যবধানের ব্যাপারটি কি কোন শিক্ষক বান্ধব সমাধানযোগ্য ছিল না? এখন প্রশ্ন আসতে পারে জনাব আনিসের পদোন্নতি টি কেন বহাল রাখতে হবে যেখানে পূর্বে অভিজ্ঞতা সনদে “To whom it may concern” থাকার কারণে অনেক শিক্ষকবৃন্দ পদোন্নতি পাননি? পদোন্নতি টি বহাল রাখা এজন্যই বাঞ্চনীয় যে প্রশাসনের ভুলের কারণে এবং সিন্ডিকেটের নেওয়া পদন্নতির স্থগিতকরণ এর সিদ্ধান্তের ফলে জনাব আনিসের মানসিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে ।
সাধারণত ভুল হলে এর কম্পেন্সেশন করা হবে এমনটাই আশা করা হয়! অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হতে এমন একটা সিদ্ধান্ত এল যা সত্যিই দুঃখজনক! বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে জনাব আনিসের এর আত্মসম্মান হানি ও বিড়ম্বনার মাধ্যমে. কিন্তু কেন? কারণটা আসলে ওপেন সিক্রেট! বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ক্ষমতা অথবা ছায়ায় লালিত শিক্ষকদের তালিকায় আসলে জনাব আনিসের নাম নেই! তাই বাস্তবতা আর তার জন্য বড়ই কঠিন! এ সত্যটা আপনার-আমার সবারই জানা. সুতরাং জনাব আনিসের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা তাকে সুপরিকল্পিতভাবে সামাজিক অর্থনৈতিক ও মানসিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার ব্যাপারটি ও ঠিক উড়িয়ে দেওয়া যায় না । তাই দয়া করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার অজুহাতে এবং ক্ষমতার পদলেহনের উদ্দেশ্যে জনাব আনিস এর সাথে ঘটে যাওয়া এই অন্যায় কে মানবিক ভাবে দেখার অনুরোধ করবেন না! যা হচ্ছে তা মানবিক কিছু হচ্ছেনা আর তা মানবিকভাবে দেখার সুযোগ ও নেই তা আপনার আমার সবারই জানা!