স্কুলের ক্লাসরুমে ব্ল্যাকবোর্ডে চক-ডাস্টার দিয়ে শিক্ষার্থীদের জীবন গড়তে যে শিক্ষকদের ব্যস্ত সময় পার করার কথা ছিল, চিরায়ত সে দৃশ্য আমূল পাল্টে দিয়ে সব কিছু ওলটপালট করে দিয়েছে করোনাভাইরাস নামের অদৃশ্য মহামারি।
১৫ মাস ধরে অব্যাহত থাকা এই মহামারির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নন-এমপিও ও বেসরকারি শিক্ষকরা কর্মহীন হয়ে জীবন-জীবিকার সন্ধানে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন বিচিত্র পেশা। এই ১৫ মাসে তাঁদের চশমায় জমেছে স্বপ্নের পরিবর্তে দুঃস্বপ্ন। কলমে জমেছে মরিচা। বিদ্যালয়ের প্রিয় প্রাঙ্গণ তাঁদের খুব করে টানলেও জীবিকার টানে তাঁরা হাঁটছেন অচেনা পথে। শিক্ষকতার মহান পেশা ছেড়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে বাধ্য হচ্ছেন এমন সব পেশা বেছে নিতে, যা কখনো তাঁরা কল্পনাও করেননি।
শিক্ষার্থীদের জীবন গড়ার এসব কারিগরের কারো হাতে এখন মোটরবাইকের চাবি, অনেকে করছেন রংমিস্ত্রির কাজ। কেউ রাস্তায় ফেরি করে বিক্রি করছেন ওষুধ। আবার বিদ্যালয়ে শিশু-কিশোরদের কলকাকলির মধ্যে শিক্ষাদানে অভ্যস্ত কোনো শিক্ষক জীবন বাঁচাতে খুলে বসেছেন চাল-ডালের মুদি দোকান। এমনকি জীবনসংগ্রামে বাধ্য হয়ে একটু রোজগারের জন্য কেউ কেউ দিনমজুর পর্যন্ত খাটছেন। এভাবে চাপা কষ্ট বুকে নিয়ে কোনোমতে বেঁচেবর্তে আছেন নন-এমপিও এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েক লাখ শিক্ষক।
করোনা মহামারির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে পুরো বিশ্বই এখন স্থবির। ব্যতিক্রম নয় বাংলাদেশেও। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দেশজুড়ে লকডাউন শুরুর আগেই গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তখন থেকেই মূলত নন-এমপিও এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জীবনে নেমে আসতে শুরু করে অমানিশার অন্ধকার। সরকারি ও এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা কোনোমতে টিকে থাকলেও বেকায়দায় পড়ে যান নন-এমপিও এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। আবার করোনা সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বন্ধ হতে থাকে একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। এতে এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা পড়েন বিপাকে। অনেকে সঞ্চয় ভেঙে কিছুদিন প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহ করেছেন। কিন্তু দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তাঁদের সে প্রচেষ্টাও বেশি দিন টিকিয়ে রাখা যায়নি।
সাধারণ শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এমনিতেই নন-এমপিও শিক্ষকরা সামান্য বেতন পান। এসব শিক্ষকের সংসার চলত টিউশনির আয় থেকে। কিন্তু ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে করোনা সংক্রমণ সে পথও বন্ধ করে দিয়েছে। সব কিছু বন্ধ থাকায় মানসিক এবং মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে এসব শিক্ষকদের জীবনে। বিশেষ করে যেসব শিক্ষক ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে বাস করছেন, তাঁরা মুখোমুখি হন দুর্বিষহ এক পরিস্থিতির। গ্রামাঞ্চলে অনেক শিক্ষক চক্ষুলজ্জা ভুলে এমন কিছু পেশায় নিযুক্ত হয়েছেন, জীবনে যা তাঁরা কল্পনাও করেননি। অনেকে আবার কোনো কাজও পাননি। বেকারত্ব তাঁদের জীবনকে করে তুলেছে অভিশপ্ত। শিক্ষকদের এই করুন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া সহায়তা বিতরণে নয়ছয় হওয়ায় অনেকের কাছে তা পৌঁছায়নি। তালিকায় নাম উঠলেও অনেকে প্রধানমন্ত্রীর অনুদান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কালের কণ্ঠ’র কাছে অনেক শিক্ষক এমন অভিযোগ করেছেন।
সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। সম্প্রতি ফের করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশঙ্কা করছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সম্ভাবনা আরেক দফা মুখ থুবড়ে পড়ল। করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হলে শিক্ষকদের হতাশাও আরো দীর্ঘ হবে। এর মধ্যেই অন্যান্য প্রায় সব খাত খুলে দেওয়ার কথা তুলে ধরে শিক্ষক নেতারা বলছেন, পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হোক। একসঙ্গে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব না হলেও ধাপে ধাপে শিডিউল করে শিক্ষাব্যবস্থাকে জাগিয়ে তোলা হোক।
তবে শিক্ষক নেতাদের এই দাবি এখনই পূরণ না হওয়ার ইঙ্গিত মিলেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেনের কথায়। গতকাল শুক্রবার কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে আলাপকালে প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার জন্য তাঁদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। কিন্তু এখনই খুলে দেওয়া হবে কি না তা বলা মুশকিল। কারণ এটি একটি জাতীয় সিদ্ধান্তের বিষয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের সমন্বয়ে এ সিদ্ধান্তটি নিতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগ যদি মনে করে, পরিস্থিতি এখনো প্রতিকূলে, তবে কোনোভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া সম্ভব হবে না।
মন্ত্রী আরো বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নির্ধারিত সময়েই পরিশোধ করা হচ্ছে। তাঁদের দিক থেকে কোনো অভিযোগ-অনুযোগ নেই। তবে এটা সত্যি, এর বাইরে নন-এমপিও এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক মিলিয়ে বড় একটি অংশ রয়েছে, যারা ঠিকমতো বেতন পাচ্ছেন না। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কিভাবে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো যায়, সে বিষয়ে সরকারের প্রস্তুতি আছে।
সূত্র মতে, বর্তমানে দেশে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার নন-এমপিও স্কুল-কলেজ ও মাদরাসায় এক লাখ ১০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। এ বছর দুই হাজার ৬১৫টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হওয়ায় এদের মধ্যে ৩০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী সরকারি বেতনের আওতায় এসেছেন। এখনো অনিশ্চয়তায় রয়েছেন ৮০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী। ৩৫২টি নন-এমপিও কলেজের ১০ হাজার শিক্ষকের আর্থিক অবস্থাও শোচনীয়।
দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকরাও। দেশে এমন চার হাজার ৩১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২১ হাজার শিক্ষক আছেন। এর মধ্যে মাত্র এক হাজার ৫১৯টি মাদরাসার প্রধান শিক্ষকদের আড়াই হাজার টাকা এবং সহকারী শিক্ষকদের দুই হাজার ৩০০ টাকা ভাতা দেয় সরকার। অন্যদিকে দেশে প্রায় ৬৫ হাজার কিন্ডারগার্টেনে সাত লাখ শিক্ষক রয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠান চলে ভাড়াবাড়িতে। ব্যক্তিমালিকানাধীন এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শতভাগ নির্ভরশীল শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর। টিউশন ফির টাকায় বাড়িভাড়া, নানা ধরনের বিল ও শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিষদের চট্টগ্রাম বিভাগের আহ্বায়ক খুরশিদ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রায় সব খাতই এখন খুলে দেওয়া হয়েছে। যাদের ঘরে রাখতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে, সেই ছেলে-মেয়েরা কিন্তু ঘরে নেই। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার যৌক্তিকতা দেখি না।
খুরশিদ আলম নিজে ‘লাইমলাইট গ্রামার স্কুল’ নামে একটি কিন্ডারগার্টেনের প্রতিষ্ঠাতা। বেসরকারি শিক্ষকদের দুরবস্থার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, অনেকে পেশা বদল করেও রক্ষা পাচ্ছেন না। তাঁদের ঘিরে ধরেছে চরম হতাশা। চার কোটি শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রায় আট কোটি মা-বাবাও হতাশ। নির্বাচন হচ্ছে, মিছিল-মিটিং হচ্ছে, গার্মেন্ট, বাজার, দোকানপাট সব খোলা। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে কোনো লাভ নেই। বরং এ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট, মাদকে আসক্ত হয়ে বিপথে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
করোনা পরিস্থিতির নির্মম শিকার চট্টগ্রামের শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম। ছয় বছর আগে নিজের সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে হালিশহরে গড়ে তুলেছিলেন তাসফিয়া মডেল একাডেমি নামে একটি কিন্ডারগার্টেন। তিনি ও তাঁর স্ত্রী হাসিনা আক্তার আগে থেকেই শিক্ষকতা পেশায় জড়িত। এখানে তাঁদের সব কিছু চলছিল পরিকল্পনামাফিক। দুই শ পার হয়েছিল শিক্ষার্থীর সংখ্যা। হঠাৎ করোনার ঝাপ্টায় তাঁদের সব কিছু তছনছ হয়ে গেছে।
শিগগিরই স্কুল খোলার কোনো আশা না থাকায় জাহাঙ্গীর কলম ছেড়ে হাতে তুলে নিয়েছেন মোটরসাইকেলের চাবি। নিজের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে আসেন রাস্তায়। এক-দুটি ট্রিপ মেরে ডাল-ভাতের খরচ জোগাড় করতে বাধ্য হলেন। এখন তিনি নিয়মিত রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাওর মাধ্যমে যাত্রী বহন করছেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম কিছুদিন বন্ধ থাকবে, এ আর সমস্যা কী। পরে যখন ধাপে ধাপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লকডাউনের মেয়াদ বাড়তে লাগল, তখন সব শিক্ষককে নিজ নিজ এলাকায় চলে যেতে বলি। কারণ তাঁদের বেতন-ভাতা দেওয়ার উপায় নেই। তিন সন্তানসহ পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়েই হিমশিম খাচ্ছি আমি।’
রংমিস্ত্রির পেশা বেছে নিয়েছেন দিনাজপুরের শিক্ষক জাহেদুল ইসলাম। বিরামপুরের মুকুন্দপুর মডেল কিন্ডারগার্টেনের এই শিক্ষক সন্তানদের মুখে একমুঠো খাবার তুলে দিতে আর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। স্কুলের সামান্য বেতনের পাশাপাশি টিউশনি করে সংসার চালাতেন। জাহেদুল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্কুল বন্ধ হওয়ার পর বেতনও বন্ধ। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ধারদেনা করে কয়েক মাস কাটিয়েছি। উপায়ান্তর না পেয়ে দিনমজুরিও করেছি। অন্যের জমিতে ধান বুনেছি। আর বাধ্য হয়ে এখন রংমিস্ত্রির কাজ করছি। তবু স্বস্তি, সন্তানদের মুখে একটু খাবার তুলে দিতে পারছি।’
বাড়ির পাশে মুদি দোকান দিয়ে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন ঠাকুরগাঁওয়ের শিক্ষক বখতিয়ার আলম। জে আর পি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের এই শিক্ষকেরও আয়ের উৎস ছিল স্কুলের সামান্য বেতন, সঙ্গে টিউশনি। ভালোই কাটছিল সব কিছু। কিন্তু স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেতনও বন্ধ হয়ে যায়। ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েন তিনি। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে আরো কিছু টাকা ধার নিয়ে শুরু করেন মুদি দোকান। কিন্তু জীবনের অনিশ্চয়তা এখনো তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়।