যেখানে তিন দশক পার করা একটি রাজনৈতিক দলকে প্রশ্ন করা উচিত ছিল- অমর একুশে এবং জাতীয় দিবসসমূহ সর্বতোভাবে উদযাপন করতে কেন তাদের এত দেরি হল? সেখানে কতিপয় দ্বীনি আঁতেল ও নির্বোধ দ্বীনদরদী প্রশ্ন করছে কোরআন তেলাওয়াতের স্থান নিয়ে! শহীদ মিনার বাঙালির ইতিহাসের অমর স্মারক। এটার সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক আবেদন চরমোনাইরা মাত্র বুঝতে শুরু করেছে। স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার, বধ্যভূমি এসব রাজনৈতিক সংগ্রামের স্বারক স্থাপনায় শহীদের স্মরণে কোরআনের তেলাওয়াতে সমস্যা কোথায়? মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা, গুরুদুয়ারাতে দাঁড়িয়ে যেখানে নামাজ পড়া যাবে সেখানে শহীদ মিনার কি এমন অপবিত্র স্থান, যেখানে কোরআন তেলাওয়াত করলে কোরআনের পবিত্রতা নষ্ট হয়?ধর্ম নষ্ট হয়?
দিবসে সমস্যা? ইসলাম নিজেইতো একটি দিবস উদযাপনের ধর্ম। ঈদ, কোরবানি, হজ, সিয়াম, শবে কদর, নিসফে শাবান কোনটি নির্দিষ্ট দিবসের বাইরে?
সমস্যা ইসলামেও নাই রাজনীতিতেও নাই। সমস্যা হচ্ছে ইসলামপন্থীদের প্রতিহিংসাপরায়ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে। এরা না বুঝে ধর্ম না বুঝে রাজনীতি না বুঝে সমাজ-সংস্কৃতি এবং চলতি জনপ্রবণতাকে। ইসলামী আন্দোলন এবং তার সহযোগী সংগঠনগুলো যদি ঘোষণা করে তারা একযোগে দেশের সকল শহীদ মিনারে কোরআনখানি এবং ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিংবা তাদের দলীয় সম্মেলন আয়োজন করতে পারে। এই জায়গা গুলো এখন পুরোপুরি সেকুলারদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অভায়ারণ্য। ইসলামী আন্দোলনের এই সক্ষমতার জায়গাটাতে প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক ব্যানার সর্বস্ব ইসলামপন্থী রাজনৈতিক কর্মীদের সমস্যা। শহীদ মিনারে কোরআনখানীর মতো সেই জনবল, সাংগঠনিক কাঠামো, সুদূর প্রসারী চিন্তক এবং দূরদর্শী নেতৃত্ব তাদের নাই। তারা যেহেতু পারবে না, সেজন্য স্রেফ প্রতিহিংসাবশত ধর্মকে টেনে এনে পারঙ্গম ইসলামপন্থীদের পথে তারা অন্তরায় সৃষ্টি করে। এই বিতর্কের আচ্ছাদন ধর্ম হলেও উদ্দেশ্য পুরোপুরি রাজনৈতিক। সোজা কথায়, আমি খেতে পারি না তাই তোকেও খেতে দিব না। এই আরকি।
আমি তো মনে করি, স্থান হিসেবে শহীদ মিনার, স্মৃতি সৌধ, বদ্ধভূমিকে কোরআন তেলাওয়াত এবং উন্মুক্ত নামাজ আদায়ের জায়নামাজ হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমে ইসলামের একটি সাংস্কৃতিক বিজয়ের সূচনা হয়েছে। এটা যদি না হতো সেখানে হয়তো বালিকাদের উদ্দাম নৃত্য হতো। সেখানে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণে মেয়েরা ইভ টিজিংয়ের শিকার হতো। এটা কি তবে ফতোয়াবাজদের কাছে বেশি ইসলামী হতো?
ইসলামপন্থীদের পিছিয়ে পড়ার একটি বড় কারণ হচ্ছে ফতোয়ার নির্যাতন। ইসলামপন্থীরা রাজনীতি করতে এসে কদমে কদমে ফতুয়া খুঁজে। আবার তারা তাদের মত করে রাজনীতি করতে গেলে অন্য ইসলামপন্থীরা ফতোয়া ছুড়ে মারে। ফতুয়া হচ্ছে এদেশের সমাজ সংস্কৃতিতে ইসলামপন্থীদের মিশে যাওয়ার একটি প্রধান অন্তরায়। ফতোয়ার অস্ত্র ব্যবহার করে ১৯৭১ এ বাংলাদেশ বিরোধিতার কিতাবি মৌলভীরা।তাদের অনুসারীরা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকাকে এখনো মহান এবং নির্ভুল মনে করে। খোদ ইসলামপন্থীরা যখন মুক্তিযুদ্ধের স্মারক গুলোকে নিজেদের বিচরণক্ষেত্র বানায় তখন স্বাধীনতা বিরোধীদের উত্তরসূরিরা নিজেদের অতীত রাজনৈতিক অবস্থানের গালে এটিকে বড় ধরনের চপেটাঘাত মনে করে। তারা কখনো চায় না অগ্রসর ইসলামপন্থীরা মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন এবং এ দেশের বর্তমান অস্তিত্বকে মনে-প্রাণে ধারণ করুক। এতে করে তারা ধর্মের রং লাগিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক অক্ষমতা এবং জনবিচ্ছিন্নতাকে আড়াল করতে চায়।
ইসলামী আন্দোলনের উচিত হবে এই চিহ্নিত মহলের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ষড়যন্ত্রে বিভ্রান্ত না হয়ে সাধারণ গণমানুষের মনোভঙ্গিকে শ্রদ্ধা করা। এটি যদি তারা বুঝতে ভুল করে তারা অতীতের ন্যায় একটি নির্দিষ্ট হুজুর বৃত্তে গুরুপাক খাবে কখনো গণ রাজনীতির মহাসড়কে উঠতে পারবে না। মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন এবং বাংলাদেশকে আবেগ দিয়ে উদযাপনের নাম নিষিদ্ধ জাতীয়তাবাদ কিংবা আসাবিয়ত নয়। তাহলে রাসুল নিজেও বড় জাতীয়তাবাদী। হিজরতের সময় তিনি বারবার পিছন ফিরে বলেছিলেন “মক্কা আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। যদি আমাকে এখান থেকে বের করে দেয়া না হতো আমি কখনো এই দেশ ত্যাগ করতাম না।” আল্লাহ সমস্ত নবীদের কে তার স্বজাতির কাছেই প্রেরণ করেছেন। এক একটি জাতির এক একটি ইতিহাস থাকে। ঐতিহ্য থাকে। গর্ব করার মত কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে। এগুলোকে ধারণ করা, উদযাপন করা জাতীয়তাবাদ কিংবা আসাবিয়্যাত নয়। এমনকি বিশ্বনবীর আগে কোন নবী সর্বজনীন এবং বিশ্বজনীন ছিলেন না। তাদের প্রত্যেকের কর্মক্ষেত্র সুনির্দিষ্ট ছিল। সমালোচকদের মতে তাহলে প্রত্যেক নবী ছিলেন জাতীয়তাবাদী! আপনি আগে বাংলাদেশে ইসলাম কায়েম করেন তারপর মায়ানমার এবং ভারত নিয়ে ভাবিয়েন কেমন?
বাংলাদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার জন্য আপনার যা যা করা প্রয়োজন, শরীয়তের রোখসতের সুযোগ নিয়ে হলেও, অথবা নিজেদের প্রভাব সৃষ্টির আগ পর্যন্ত সাময়িক কৌশলগত ব্যবস্থা হিসেবে হলেও দেশের ঐতিহাসিক উপলক্ষগুলোকে সবচেয়ে আড়ম্বরপূর্ণভাবে উদযাপন করা উচিত। যেন ইসলামপন্থীদের উদযাপন হয় সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং তাক লাগানো।
শহীদ মিনারে একটি রাজনৈতিক দলের কুরআন খানি নিঃসন্দেহে আমি সমর্থন করি। আপনি বলবেন এটি রাজনৈতিক এবং লোক দেখানো। ঠিক আছে তো। রাজনৈতিক এবং লোক দেখানো, ধরেন আমার সওয়াব হলো না, দুনিয়াবী ফায়দা তো আছে!
কিন্তু মাদ্রাসায় শহীদ মিনার বানিয়ে সেখানে শহীদ দিবস পালন করাটা নিষ্প্রয়োজন এবং দৃষ্টিকটু। কিছু কাজ থাকে রাজনৈতিক দলের। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেগুলো কেন পালন করবে?রাজনৈতিক দলের প্রত্যেকটা কর্মসূচির পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। যা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিছুতেই প্রযোজ্য নয়।
শহীদ মিনার এবং স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের শিরকী গুনাহ হয়।প্রভাতফেরীতে নারী পুরুষের পর্দা খেলাফের ঘেঁষাঘেঁষি হয়। এর বিরুদ্ধে প্রচুর ওয়াজ হয়েছে। কিন্তু এসব বেড়েছে, বন্ধ হয়নি। ইসলামী আন্দোলন একটা কাজের কাজ করেছে। তারা এই গুনাহের অপচর্চাকে তেলাওয়াত ও নফল সালাতের সওয়াবে প্রতিস্থাপন করেছে। পুষ্পস্তবক অর্পণের বিজাতীয় শিরেকী সংস্কৃতিকে অপনয়নের চেয়ে সুন্দর পদ্ধতি আর কি হতে পারে? আজব ব্যাপার হচ্ছে একটা সময় ওলামায়ে কেরামরা বলতেন, ফুল না দিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে শহীদদের স্মরণে সুরা ফাতেহা এবং এখলাস পড়ার জন্য। তো সেখানে কোরআনুল কারিমের তেলাওয়াত হলে তো আরো ভালো। এর দ্বারা জাতীয় দিবসে কোরআন পাঠের একটি সংস্কৃতি তৈরি হয়ে যায়।এর থেকে কি এক মিনিট নীরবতা পালন করা, পুষ্পস্তবক অর্পণ করা শ্রেয়?