বেফাক সংকটে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উলামায়ে কেরামের ব্যক্তিত্ব। আবহমান কাল থেকেই দেশের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো চলেছে ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে, ব্যক্তির প্রভাব ও ব্যক্তির ওপরে আস্থা রেখে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মাদ্রাসাই কোন না কোন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এখনো মাদ্রাসাগুলো চলে মূলত ব্যক্তি নির্ভর হয়ে। মুহতামিমগন “প্রায় ইসমত” এর মর্যাদা ভোগ করেন। তাদের বহু দৃশ্যত ভুলকে “মাসলাহাত” বলে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবনতা ছিলো।
কিন্তু বেফাকের চলতি সংকট সেই পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে। “শুধু ব্যক্তি নির্ভর হয়ে থাকা” অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার ছিলো। কারণ “শুধু রিজাল নির্ভরতা” ভ্রান্তি ডেকে আনে। ইসলাম এজন্যই “রিজাল ও কিতাব” এর সমন্বয় করেছে। রিজালকে যাচাই করতে হয় কিতাব দিয়ে আর কিতাব বুঝতে হয় রিজাল দিয়ে। তাহলেই الۡمَغۡضُوۡبِ عَلَیۡہِمۡ ও الضَّآلِّیۡنَ হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
তাই রিজাল নির্ভরতা কাটিয়ে কিতাব ও রিজালের সমন্বিত পদ্ধতির অনুসরন করতেই হতো। তবে সেটা রিজালদের বোধদয়ের মাধ্যমে হলো ভালো হতো। সেটা না হয়ে যখন বেদনার সৃষ্টি হয়েছে তখন সেই বেদনাকে “প্রসববেদনা” ধরে নিয়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে “রিজাল-কিতাব” এর সমন্বয় সাধন করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে।
সেজন্য যে কাজগুলো করা উচিৎ..
১. বেফাকের সুনির্দিষ্ট Organogarm বা সংগঠন কাঠামো প্রস্তুত করা।
এটা করার আগে বেফাকের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আগে সুনির্দিষ্ট করতে হবে। এটা কি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নাকি এটা একটা শিক্ষাবোর্ড?
রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা ঐক্যমঞ্চ ধরনের প্রতিষ্ঠান হলে তার কাঠামো এক রকম আর শিক্ষাবোর্ড হলে তার সংগঠন কাঠামো আরেক রকম।
একটা শিক্ষাবোর্ডের এতোজন সহ-সভাপতি দরকার হয় না। শিক্ষাবোর্ডের কমিটিতে এতো মানুষেরও দরকার হয় না। এমনকি শিক্ষাবোর্ডের “কমিটি” ই দরকার হয় না। শিক্ষাবোর্ডের দরকার হয় কর্মকর্তা-কর্মচারী। তারপরেও যদি নীতি নির্ধারণের জন্য কোন কমিটি করতে হয় তাহলেও সেই কমিটির সুনির্দিষ্ট সংখ্যা ও পদবিন্যাস নির্ধারণ করতে হবে। একটা শিক্ষাবোর্ডের কমিটি আর কোন রাজনৈতিক দলের কমিটি এক কথা না সেটাও বিবেচনা করতে হবে।
২. কমিটি সদস্য ও কর্মকর্তা-কর্মচারী মনোনয়ন পদ্ধতি নির্ধারণ করা।
কমিটি সদস্য নিয়োগের জন্য অবাধ,সুষ্ঠু ও নিরেপেক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি অনুসরন করা যেতে পারে। কারা ভোটার হবেন তারও সুস্পষ্ট নীতিমালা করতে হবে। কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের জন্য পিএসসির আদলে আলাদা স্বাধীন কোন সংস্থা বা বোর্ড গড়ে তুলতে হবে।
৩. কমিটির সদস্য ও কর্মকর্তা-কর্মচারিদের যোগ্যতা।
ক. বেফাক যেহেতু একটি উচ্চশিক্ষা বোর্ড সেহুতু এর কমিটি সদস্য হিসেবে ও কর্মকর্তা-কর্মচারী মনোনয়নের ক্ষেত্রে একাডেমিক বিবেচনাই একমাত্র বিবেচনা হওয়া উচিৎ। একাডেমিক যোগ্যতার মূল্যায়ন কি হবে তাও নির্ধারণ করা উচিৎ।
খ. ইসলামী রাজনৈতিক অঙ্গন পারস্পরিক বিদ্বেষপূর্ণ। সেজন্য কমিটি সদস্য ও কর্মকর্তা-কর্মচারিদের দল নিরেপেক্ষ হওয়া বাঞ্চনিয়।
গ. বয়স সীমা নির্ধারিত থাকা। রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বার্ধক্য থেকে পানাহ চেয়েছেন। বার্ধক্যে মানুষ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। সেজন্য বেফাকের কর্মকর্তা-কর্মচারি ও কমিটি সদস্যদের মেয়াদ সর্বোচ্চ ৬৫ বছর করতে হবে।
ঘ. বেফাকের কোন দায়িত্বে এলে তাকে অবশ্যই সকল মাদ্রাসা থেকে সব ধরনের দায়িত্ব অব্যহতি নিতে হবে। একই সাথে বোর্ড ও মাদ্রাসার দায়িত্বে থাকা যাবে না।
৪. কমিটি সদস্য ও কর্মকর্তাদের মেয়াদ।
কমিটির সদস্য ও কর্মকর্তাদের মেয়াদ ৩-৫ বছর করা যায়। তবে শর্ত থাকবে যে, একই ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি শীর্ষ পদসমূহে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।
৫. কর্ম বিবরণ নির্ধারণ করা। (Job Description)
বেফাকের কমিটি ও কর্মকর্তা-কর্মচারিদের কার কি কাজ তা সুনির্দিষ্টভাবে লিখিত থাকতে হবে। এসব দায়িত্ব পালন করার শর্তেই কেউ এখানে যোগ দেবে। কোন দায়িত্ব পালন করতে না পারলে সে শাস্তিযোগ্য হবে।
৬.সুযোগ-সুবিধা
বেফাকের কর্মকর্তা-কর্মচারিগন কি কি কাজের বিনিময়ে, কতক্ষণ কাজের বিনিময়ে কি কি সুযোগ-সুবিধা পাবেন তা নির্ধারিত থাকতে হবে।
৭. নিরেপেক্ষ ও সুখ্যাতি সম্পন্ন অডিট হাউস দ্বারা বার্ষিক অডিট করাতে হবে।
এছাড়াও প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য যেসব কৌশল ও পদ্ধতি আছে তার সবগুলোই বেফাকে অনুসরন করতে হবে। যাতে করে নফসের ওয়াসওসায় কেউ কোন ভুল করতে না পারে। এভাবে যদি নিয়ম-নীতির মধ্যে বেফাক পরিচালিত হয় তাহলে বেফাকের রিজাল বিতর্কের উর্ধে থাকবেন।
অন্যথায় যেভাবে আমরা রিজাল নির্ভর হয়ে আছি এবং রিজাল যেভাবে বিতর্কিত হচ্ছে তাতে এদেশে ইসলামের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।
আল্লাহ বেফাক সংকট থেকে উলামায়ে বাংলাদেশকে রক্ষা করুন।
লেখক: শেখ ফজলুল করীম মারুফ লেখক ও গবেষক ই-মেইল: fkmarufdu@gmail.com