আরবী ‘কুরবানুন’ শব্দের অর্থ নৈকট্য লাভ। ব্যাপক অর্থে, যে বস্তু দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। চাই তা’ যবেহকৃত, বা অন্য কোন দান-অনুদান হোক।
তাফসীরে মাযহারীর বর্ণনা মতে- আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নযর-মান্নত রূপে যা পেশ করা হয় তাকে বলা হয় ‘কুরবান’। ইমাম আবুবকর জাস্সাস (রহ.) বলেন, “আল্লাহর রহমতের নিকটবর্তী হওয়ার জন্য কৃত প্রত্যেক নেক আমলকে কুরবান বলা হয়।” শরীয়তের পরিভাষায় কুরবান বলা হয় আল্লাহর নৈকট্য লাভে যা নিবেদন করা হয়- তা জন্তু হোক বা অন্য কিছু। তবে প্রচলিত অর্থে এ উদ্দেশ্যে জন্তু যবেহকে বলা হয় কুরবান। ‘উযহিয়া’, তার সমার্থবোধক শব্দ।
হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত প্রতিটি ধর্মে, প্রতিটি যুগে কুরবানীর প্রথা চালু রয়েছে। যদিও একেক ধর্মের নিয়ম-পদ্ধতি একেক ধরনের। কুরআনের সূরা মায়িদায় আদমপুত্র হাবিল ও কাবিলের কুরবানীর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পাওয়া যায়। সূরা সাফ্ফাতে হযরত ইবরাহীম (আ.) কর্তৃক পুত্র ইসমাঈলের কুরবানীর যে বিবরণ রয়েছে, যা ইতিহাসের এক স্মরণীয় অধ্যায়।
বস্তুত ইসলামী শরীয়তের কুরবানী একে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। সাহাবায়ে কেরাম একদা রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এর প্রতি আরয করে বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! কুরবানীগুলো কী? রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ইরশাদ করেন, “তোমাদের পিতামহ ইবরাহীম (আ.)এর সুন্নাত।” তাঁরা পুনঃ জিজ্ঞাসা করেন, এতে কি পাওয়া যায়? রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ইরশাদ করেন, “প্রতি লোমের বিনিময়ে একটি করে নেকি”। (ইবনে মাযাহ্)। এ হাদীসের টীকায় মোল্লা আলী কারী (রহ.) বলেন, “কুরবানী পূর্ববর্তী শরীয়তের এমন এক ইবাদত, যা ইসলামী শরীয়তও বহাল রেখেছে।”
কুরআন মাজীদে আছে-
وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا وَبَشِّرِ الْمُخْبِتِينَ
“এবং আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কুরবানীর প্রথা জারী রেখেছি। যাতে তারা আমার দেয়া চতুষ্পদ জন্তুর উপর আমার নাম নেয়”। (সূরা হজ্জ)।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা আলুসী (রহ.) বলেন, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবানীর প্রথা সকল আসমানী ধর্মে বিধিবদ্ধ করে দেয়া হয়। তাফসীরে হক্কানীতে উল্লেখ আছে- “হযরত মূসা, ইয়াকুব, ইস্হাক ও ইবরাহীম (আ.)এর শরীয়ত সমূহে কুরবানী করা ধর্মের আইন রূপে স্বীকৃত ছিল। বহুতর বিকৃত বর্তমান বাইবেলেও কুরবানীর উল্লেখ রয়েছে অনেক জায়গায়। এমনকি হিন্দু ধর্মেও কুরবানী প্রথার প্রচলন দেখা যায়। নিম্নে কুরবানীর কতিপয় ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হল, যাতে এর গুরুত্ব ও ফযীলত সম্বন্ধে অবহিত হওয়া যায়।
মানুষের ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানীর প্রচলন হয় হযরত আদম (আ.)এর পুত্রদ্বয় হাবিল ও কাবিলের হাতে। কুরআন মাজীদের সূরা মায়েদায় আছে-
وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِن أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الآخَرِ قَالَ لَأَقْتُلَنَّكَ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ
“এবং আদম পুত্রদ্বয়ের সত্য ঘটনা লোকদের শোনাও। যখন তারা উভয়ে কুরবানী পেশ করে। অতঃপর এক জনের (হাবিল) কুরবানী কবুল হয় এবং অপর জনের (কাবিল) অগ্রাহ্য হয়। তখন কাবিল হাবিলকে বলে, আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। হাবিল বলে, আল্লাহ্ পরহেযগারের কুরবানীই কবুল করেন”। (সূরা মায়িদাহ, আয়াত-২৭)।
তাফসীরে ইবনে কাসীর ও মাযহারী প্রবৃতির বর্ণনা মতে হাবিল কাবিলের কুরবানী কী ছিল, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে দেয়া হল।
হযরত আদম ও মা হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে অবতরণের পর থেকে তাঁদের ঔরষে মানবজাতির বংশধারা শুরু হয়। হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত আছে যে, তাঁদের মৃত্যুর সময় মানুষের সংখ্যা ৪০ হাজারে উপনীত হয়েছিল। মা হাওয়া মোট কুড়ি বার সন্তান জন্ম দান করেন এবং প্রতিবার এক ছেলে ও এক মেয়ে জন্ম দিতেন। তাঁদের প্রথম পুত্র ছিল কাবিল ও প্রথম কন্যা একলিমা। দ্বিতীয় পুত্র হাবিল ও দ্বিতীয় কন্যা লুবাদা। সর্বশেষ ভূমিষ্ঠ হয় আবুল মুগীস ও উম্মুল মুগীস। তাই তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক হল ভাই ও ভগ্নির। এবং ভাই-ভগ্নির মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক নীতিগত ভাবে অবৈধ। তবে অবস্থা ও প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে আদম (আ.)এর শরীয়তে তখন এ হুকুম দেয়া হয় যে, একই সাথে ভূমিষ্ঠ ভাই ও ভগ্নি হবে সহোদর এবং দুয়ের মধ্যে বিবাহ হতে পারবে না। তবে দু সময়ে ভূমিষ্ঠ ভাই ও ভগ্নির মধ্যে বিবাহ হতে পারবে। এভাবে চলছিল মানব বংশের সিলসিলা।
সে যা’ হোক আদম (আ.) এর প্রথম পুত্র কাবিলের সাথে যে মেয়ে ভূমিষ্ঠ হয়, তা ছিল খুবই সুন্দরী। আর হাবিলের সাথে ভূমিষ্ঠ মেয়েটি ছিল কিছুটা কদাকার। অতঃপর বিবাহের সময় হলে শরীয়ত মতে সে পড়ে কাবিলের ভাগে, আর সুন্দরীটি পড়ে হাবিলের ভাগে। কিন্তু কাবিল এতে অসন্তুষ্ট হয়ে দাবি করে যে, তার সাথে ভূমিষ্ঠ ভগ্নিকে তার চাই। কিন্তু পিতা আদম (আ.) তা অস্বীকার করেন। ফলে সে বেশ রাগান্বিত হয় এবং হাবিলের শত্রু হয়ে উঠে। পিতা আদম (আ.) উভয়ের সংঘাত নিরসনকল্পে একটি পন্থা বের করে বলেন, “তোমরা দু’জনে আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে কুরবানী পেশ করো। যার কুরবানী কবুল হয়, তার আকদে ঐ মেয়েটি দেয়া হবে।” সেকালে কুরবানী কবুল হওয়ার লক্ষণ হিসেবে আসমান থেকে এক ধরনের আগুন এসে তা’ ভস্ম করে যেত। কিন্তু যা কবুলযোগ্য নয়, তাকে আগুন স্পর্শ করত না।
মোটকথা, পিতার আদেশ মতে হাবিল একটি মোটা তাজা দুম্বার কুরবানী পেশ করে। আর কাবিল পেশ করে কিছু শস্যদ্রব্য। কারণ, সে ছিল কৃষিজীবী। কিন্তু পরে দেখা যায় হাবিলের কুরবানীকেই শুধু আগুন স্পর্শ করেছে কবিল এতে ভয়ানক রাগান্বিত হয়ে ভাই হাবিলকে বলে, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। হাবিল গম্ভীর স্বরে এতটুকু বলে, “আল্লাহ্ পরহেযগারের আমলই কবুল করে থাকেন।” কিন্তু কে শোনে ধর্মের কথা? কাবিল হাবিল থেকে বড় নির্মম প্রতিশোধ নেয় এবং তাকে শেষ পর্যন্ত হত্যা করে বসে।
হযরত নূহ (আ.)এর যুগে প্রচলিত কুরবানী প্রথার উল্লেখ করে মিসরের প্রখ্যাত আলেম মুহাম্মদ ফরীদ ওয়াজদী ‘দায়েরাতুল মাআরিফ’ গ্রন্থে প্রমাণ সহকারে বলেন, হযরত নূহ (আ.) জন্তু যবেহ করার উদ্দেশ্যে একটি ‘কুরবানগাহ’ নির্মাণ করে ছিলেন। তাতে যবেহকৃত জন্তু আগুন দ্বারা জ্বালিয়ে দিতেন। তারপর দুনিয়ার ইতিহাসে নজিরবিহীন কুরবানী পেশ করেছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ.) এবং তাঁর যুগ থেকেই একটি গুরুত্বপুর্ণ ইবাদত হিসেবে এর প্রচলন শুরু হয়। কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর সেই নজিরবিহীন কুরবানীর স্মৃতিকে দুনিয়ার বুকে কায়েম রাখার জন্যে আমাদের শরীয়ত প্রত্যেক সামর্থ্যবান লোকের উপর কুরবানী ওয়াজিব করে দেয়। কুরআন মাজীদের সূরা সাফ্ফাতের কতিপয় আয়াতে হযরত ইবরাহীম (আ.)এর কুরবানীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে বলা হয়, “তাঁর এ স্মৃতিকে পরবর্তী মানব সমাজের মধ্যে বহাল রাখা হবে।” মুহাম্মদী শরীয়তের কুরবানীর উৎসব হিসেবে হযরত ইবরাহীম (আ.)এর উক্ত কুরবানীর কিছু বিবরণ পেশ করা এখানে আবশ্যক মনে করি।
দাওয়াত
হযরত ইবরাহীম (আ.) নবুওয়াত লাভ করার পর নবুওয়াতের দায়িত্ব পালন উদ্দেশ্যে যখন তাওহীদের প্রচার শুরু করেন, তখন সর্বপ্রথম সংঘাত বাধে তাঁর পিতা আযরের সাথে। পিতা বলে, বাপ-দাদার ধর্মের বিরুদ্ধে তোমার প্রচার অভিযান অব্যাহত থাকলে পাথর মেরে তোমাকে ঘর থেকে বের করে দেয়া হবে। কিন্তু পিতার আদেশের চাইতে আল্লাহ্র আদেশের গুরুত্ব ছিল তাঁর কাছে বেশি। ফলে পিতাসহ গোত্রের সকল লোকই তাঁর শত্রু হয়ে দাঁড়ায়।
অগ্নি পরীক্ষা
হযরত ইবরাহীম (আ.) এতসব ধমকি-হুমকি সত্ত্বেও শিরকের গহীন অন্ধকারে একত্ববাদের প্রচারে নিয়োজিত থাকেন। স্বীয় গোত্র উপায়ন্তর না দেখে তাঁকে জ্বলন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা নেয়। নির্দিষ্ট দিন-তারিখে সমকালীন খোদাদ্রোহী রাজা নমরূদের আদেশে তাঁকে অগ্নিকু-ে নিক্ষেপ করা হয় হাজার হাজার দর্শকের চোখের সামনে। ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ.) ততক্ষণাৎ এসে তাঁকে বলেন, “সাহায্যের প্রয়োজন হলে আমি হাজির।” তিনি বলেন, আপনার ব্যক্তিগত সাহায্যের প্রয়োজন নেই। যে আল্লাহ্র একত্ববাদ প্রচারের দায়ে আমি আগুনে নিক্ষিপ্ত, তিনি সব কিছু দেখেন ও শোনেন। তিনি যাই সাব্যস্ত করেন, তার উপর আমি পরম সন্তুষ্ট।” ঠিক সে সময় আল্লাহ্র আদেশ আসে-“হে আগুন, ইব্রাহীমের জন্যে শীতল ও শান্তিময় হয়ে যাও।” পরক্ষণেই দেখা যায় সমগ্র অগ্নিকুন্ড ফুল বাগানে পরিণত।
দেশান্তর
ইতিহাসের এই অদ্ভুত ঘটনা ঘটে প্রাচীন ইরাকে। প্রতাপশালী সম্রাট ও দর্শকবৃন্দ এ ঘটনায় হতচকিয়ে যায়। এ ছিল হযরত ইবরাহীম (আ.)এর এক প্রকাশ্য মুজেযা। মুজেযার খন্ডন ওদের সাধ্য-সাধনার বাইরে দেখে দেশবাসী তাঁকে দেশত্যাগে বাধ্য করে। তিনিও এ কথা বলে বিদেশের পথে পাড়ি দেন- “আমার প্রতিপালকের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে চলছি, তিনিই আমাকে হিদায়াত দান করবেন।” অতঃপর মা-বাপ, আত্মীয়-স্বজন সবকিছু ছেড়ে তিনি হযরত লূত (আ.)কে সাথে নিয়ে সুদূর ফিলিস্তিনের কিন্আন নামক স্থানে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ছিয়াশি বছর।
সন্তান লাভ
এখানে এসেও তিনি বহু পরীক্ষার সম্মুখীন হন। এছাড়া তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। ছিয়াশি বছর বয়সেও আল্লাহ্র কাছে তিনি সৎসন্তানের দোয়া করেন। আল্লাহ্ তাঁকে এক ধৈর্যশীল সন্তানের সু-সংবাদ দেন। তিনি হলেন হযরত ইসমাঈল (আ.)। পরে নিরানব্বই বছর বয়সে তাঁর আর এক সন্তানের জন্ম হয়। নাম ইসহাক (আ.)।
আর এক পরীক্ষাঃ পরম আশা ও অব্যাহত দোয়ার পর দীর্ঘ ছিয়াশি বছর বয়সে তিনি যে সন্তান লাভ করেন, পরে দেখা যায় সেই সন্তানই একের পর এক পরীক্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহর পক্ষ থেকে হুকুম আসে, “দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরা ও দুগ্ধপোষ্য ইসমাঈলকে সুদূর হিজাযের জনমানবশূন্য ধু-ধু মরু এলাকায় রেখে আস।” এ হুকুমের তা’মিল করার উদ্দেশ্যে তিনি অল্প খেজুরসহ মা ও ছেলেকে নিয়ে সিরিয়া থেকে রওয়ানা হয়ে ঠিক যেখানে বর্তমানে ‘বায়তুল্লাহ্’ শরীফ অবস্থিত, গায়েবী ইশারায় সেখানে এসে যাত্রা বিরতি ঘটান এবং খেজুরগুলো স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে কিছু না বলেই পুনঃ যাত্রা করেন। কিছু দূর গেলে স্ত্রী পেছন থেকে ডাক দিয়ে বলেন, এই জনমানবশূন্য মরু এলাকায় আমাদের কেন রেখে যাচ্ছেন? তা’ কি আল্লাহ্র হুকুম? তিনি পেছনে না ফিরে চলার গতিতেই জবাব দেন, হ্যাঁ’! স্ত্রী হাজেরা বলেন, “তা’ হলে চিন্তার কিছু নেই। আল্লাহ্ আমাদের হিফাযত করবেন।”
বৃহত্তম পরীক্ষাঃ দুগ্ধপোষ্য সন্তান নিয়ে বিবি হাজেরার একা দিনযাপন, যমযম কূপের উৎসরণ, বিদেশি বাণিজ্য কাফেলার সেখানে আগমন এবং ধীরে ধীরে মক্কায় মানুষের বসতি স্থাপনের কাহিনী বহু দীর্ঘ। সে কাহিনী অল্প বিস্তর অনেকের জানা। তাই মুখ্য আলোচনার দিকে অগ্রসর হচ্ছি।
হযরত ইবরাহীম (আ.) সিরিয়া থেকে মাঝে-মধ্যে মক্কায় এসে মা ও ছেলেকে দেখে যেতেন। ইসমাঈল শিশু থেকে কৈশোরে পদার্পণ করলে একদিন পিতা এসে বলেন, প্রিয় বৎস, স্বপ্নে দেখেছি তোমাকে নিজ হাতে যবেহ করছি। বল, তোমার কি মত? তিনি নিঃসঙ্কোচে জবাব দেন, “আব্বাজান! আল্লাহ্র সে আদেশ পালন করুন, আমাকে ইন্শাআল্লাহ্ ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।
পরদিন সকালে পিতা ও পুত্র যখন আল্লাহ্র আদেশ পালনের উদ্দেশ্যে মাঠের দিকে যাচ্ছিলেন, শয়তান এক মহা শুভাকাক্সক্ষীর বেশ ধরে বিবি হাজেরার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করে, ইসমাঈল কোথায়? তিনি বলেন, ওর পিতার সাথে কাঠ আনতে গেছে জঙ্গলে। শয়তান বলে, আসল কথা তুমি জান না। ওকে যবেহ করার জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি তাজ্জব করে বলেন, পিতা কি আপন পুত্রকে যবেহ করতে পারে? শয়তান বলে, ওর পিতা নাকি এ জন্য আল্লাহ্র আদেশ পেয়েছেন। মা বলেন, তা’হলে এ আদেশ তাঁকে পালন করতেই হবে।
শয়তান এখানে নিরাশ হয়ে পিতা ও পুত্রের পিছু নেয়। অতঃপর এক হিতৈষী বন্ধু বেশ ধরে তাঁর গতিরোধ করতে চায়। হযরত ইবরাহীম (আ.) তা টের পেয়ে শয়তানকে এড়িয়ে চলেন। পরে সে অন্য বেশ ধারণ করে পথরোধ করে দাঁড়ায়। তখন এক ফেরেশতা এসে ইবরাহীম (আ.)কে বলেন, ওকে পাথর ছুঁড়ে মারুন। তিনি সাতটি পাথর মারেন এবং প্রতি পাথরে ‘আল্লাহু আকবার’ বলেন। এখানে পাথর খেয়ে সরে গিয়ে সে একটু দূরে আবার পথ বন্ধ করে দাঁড়ায়। এখানেও তিনি তাকবীর বলে আবার সাতটি পাথর মারেন। সে আবারও সরে যায় এবং তৃতীয় বারের মত পথ আড়াল করে দাঁড়ায়। হযরত ইবরাহীম (আ.) এখানেও পূর্বের আমল করে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে পৌঁছেন। (রূহুল মাআনী, ইবনে কাসীর)। বস্তুত হাজীগণ এখনও তাঁর সেই স্মৃতি রক্ষার্থে মীনা প্রান্তরে স্থাপিত তিনটি স্তম্ভে সাতবার করে পাথর ছুঁড়ে থাকেন।
সে যাহোক, হযরত ইবরাহীম (আ.) আপন প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাঈলকে যখন আল্লাহ্র নামে কুরবানীর উদ্দেশ্যে উপুড় করে শুইয়ে দিয়ে গলায় ধারাল ছুুরি চালাতে উদ্ধত হন, ঠিক সে সময় আকাশ থেকে গায়েবী আওয়ায আসে- “ইবরাহীম ক্ষান্ত হও, অবশ্যই তুমি স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে দেখালে।”
দুম্বার ফিদিয়া
হযরত ইবরাহীম (আ.) এ আওয়ায শুনে হতচকিয়ে যান। দিগন্তলোকে দৃষ্টি দিয়ে দেখেন, হাতে এক দুম্বা নিয়ে ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ.) ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে দ্রুত আগুয়ান। পরক্ষণেই তিনি সেখানে হাযির হয়ে ছুরির তলদেশ থেকে ইসমাঈলকে টেনে নিয়ে দুম্বাকে শুইয়ে দেন এবং পর মুহূর্তে ইবরাহীম (আ.)এর হাতে তা-ই যবেহ হয়ে যায়। কুরআন এ ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে বলে, “এবং এক মহান বস্তু তাঁর ফিদিয়া রূপে দান করলাম। আর একে পরবর্তী বংশধরের জন্যে স্মরণীয় করে রাখলাম।”
হাদীস শরীফে আছে- “অপরাপর মানুষ অপেক্ষা আল্লাহর নবী-রাসূলগণ সর্বাধিক শক্ত পরীক্ষার সম্মুখীন হন।” হযরত ইবরাহীম (আ.)এর বেলায়ও তাই ঘটল। তিনি একের পর এক পরীক্ষার সম্মুখীন হন। প্রথমে মা-বাপ, আত্মীয়-স্বজন সবাই তাঁকে ত্যাগ করল। তার পর অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হন। এরপর আসে মাতৃভূমি ত্যাগের কঠিন মুহূর্ত। অতঃপর প্রাণাধিক প্রিয় ইসমাঈলের গলায় স্বহস্তে ছুরি চালানো। বাস্তবিক, এ সকল পরীক্ষা ছিল কঠিন থেকে কঠিনতম। কিন্তু তিনি প্রত্যেক পরীক্ষাকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়ে প্রমাণ করে দিলেন- “ইন্না-সালাতি ওয়া-নুসুকি……… অর্থাৎ- আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও মৃত্যু সবই বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ্র জন্য নিবেদিত।”
ইসলামে কুরবানীর গুরুত্বঃ ইতিপূর্বে আলোচনা থেকে পরিষ্কার হল যে, হযরত আদম (আ.)এর যুগ থেকে একটি স্বতন্ত্র ইবাদত হিসেবে কুরবানীর প্রথা চলে আসছে। তবে হযরত ইবরাহীম (আ.)এর যুগ থেকে এর গুরুত্ব আরও অধিকহারে বৃদ্ধি পায়। ফলে ইসলাম ধর্মেও গুরুত্ব সহকারে তা অনুমোদিত হয়। হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সা.) সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈ, তাবে তাবেঈ ও ইমামানে কেরাম থেকে এ পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র বিশেষ মর্যাদার সাথে এ’ ইবাদত চালু রয়েছে।
কুরআন মাজীদে সূরা কাউছারে ইরশাদ হয়- “অতএব, নামায আদায় কর তোমার রবের উদ্দেশ্যে এবং ‘নাহর’কর।” মুফাস্সিরীনে কেরামের মতে এখানে ‘নাহর’ অর্থ কুরবানী। তাফসীরে রুহুল মা’আনীর ভাষ্যমতে কতিপয় ইমাম ঐ আয়াত দ্বারা কুরবানী ওয়াজিব হওয়াকে প্রমাণ করেছেন। তিরমীযী শরীফের হাদীসে আছে- “হযরত আবদুল্লাহ্ বিন ওমর (রাযি.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) দশ বছর মদীনায় ছিলেন এবং প্রতি বছর কুরবানী করেন।” প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস হযরত মোল্লা আলী আল্-কারী (রহ.) ‘মিরকাত’ কিতাবে লিখেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর প্রতি বছর কুরবানী করাই কুরবানীর আমল ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ বহন করে।” এ জন্যে হযরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ছাহেবে নেসাবের উপর কুরবানীকে ওয়াজিব মনে করেন।
ইসলামে কুরবানীর শুরু:
‘ওয়াফাউল ওয়াফা’ ও ‘কিতাবুল ফিকাহ আলাল্ মাযাহিবিল আরবাআ’ নামক প্রসিদ্ধ কিতাবদ্বয়ে লিখা আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) হিজরী দ্বিতীয় সালে মদীনায় ঈদের নামায আদায় করেন এবং অতঃপর কুরবানী করেন। ইবনুল আসীর লিখিত ‘তারীখুল কামিল’ গ্রন্থে দ্বিতীয় হিজরীর ঘটনাবলী বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়- “অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বনী কায়নুকা’ যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন করলে কুরবানীর সময় এসে পড়ে। তাই তিনি ঈদগাহের দিকে গমন করেন এবং মুসলমানদের নিয়ে ঈদুল আযহার নামায আদায় করেন। আর এটি ছিল মদনী যুগের প্রথম কুরবানীর ঈদ। অতঃপর তিনি দু’টি ছাগল, অন্য বর্ণনা মতে একটি ছাগল কুরবানী করেন। আর এটি ছিল তাঁর প্রথম কুরবানী, যা মুসলমানগণ প্রত্যক্ষ করেন।”
লেখক: শায়খুল হাদীস ও শিক্ষাপরিচালক- আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
আমীর- হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।