গতকাল কওমী মাদরাসাসমূহের দাওরায়ে হাদীসের সনদপ্রদান বিষয়ক অথরিটি আল-হাইআতু্ল উলইয়া লিলজামিয়াতিল কওমিয়ার স্থায়ী কমিটির একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ মিটিং হয়েছে, ঢাকার যাত্রাবাড়ী মাদরাসায়।
এই নাজুক সময়ে মিটিংটির প্রতি অনেকেরই দৃষ্টি ছিল। হাইআতুল উলইয়ায় বাংলাদেশের কওমী মাদরাসা সমূহ নিয়ন্ত্রনকারী শীর্ষস্থানীয় এবং নির্ভর করার মতো মুরুব্বীগণ রয়েছেন। অতএব তাঁরা দ্বীন-দেশ এবং কওমী মাদরাসার স্বার্থ সব দিক চিন্তা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিবেন এ ব্যাপারে আমরা আশাবাদী ছিলাম।
আমাদের বিশ্বাস, তারা হয়তো সর্বোচ্চ এখলাসের সাথে সেই চেষ্টাই করেছেন।
হাইআর মিটিং এ যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তাতে সন্তোষ প্রকাশ করে অনেকেই ধন্যবাদ জানিয়েছেন। কেউ কেউ আবেগে, খুশিতে ফেসবুকে উল্লাসও প্রকাশ করছেন। বিবিসি আগ্রহের সঙ্গে বিশাল নিউজ করেছে।
বাংলাদেশের যেসব মিডিয়ায় কওমীবাতিক রয়েছে, তারাও সবাই মিলে মজা করে নিউজ করেছে।
কিন্তু অতিব দূঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, হাইআর গতকালের দুটি সিদ্ধান্তে আমি চরমভাবে হতাশ হয়েছি।
বাংলাদেশের ইসলামী রানৈতিক অঙ্গনের একজন নগন্য কর্মী হিসেবে প্রায় তিন যুগের ক্ষুদ্র রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে আমি মনে করছি, হাইআর গতকালের মাদরাসার ছাত্র শিক্ষকদের বিরাজনীতিকরণ সংক্রান্ত দুই নম্বর সিদ্ধান্তটি এদেশের কওমী মাদরাসা, এদেশের সামগ্রিক ইসলামী রাজনীতি এবং আমাদের প্রিয় রাষ্ট্র সবার জন্যই সুদূরপ্রসারী অকল্যাণ বয়ে আনবে। সাময়িকভাবে সরকার পক্ষের সন্তুষ্টির দিকে লক্ষ রেখে যদিও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্যে হাইআ কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি করে এমন একটি স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে অনুমান করে নেয়া যায়; কিন্তু আমার মনে হয় এমন একটি তাৎক্ষনিক মিটিং-এ হুট করে সিদ্ধান্তটি না নিয়ে আরো বিভিন্ন দিক গভীরভাবে ভাবা দরকার ছিল।
এই মূহুর্তে হাইআতুল উলয়ার এমন একটি সিদ্ধান্তের গভীরতা এবং এর সদূরপ্রসারী প্রভাব কতটুকু তা কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখেছেন কিনা তা বোধগম্য নয়।
সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, ‘কওমী মাদরাসাসমূহের ছাত্র শিক্ষকরা প্রচলিত সবধরনের রাজনীতি মুক্ত থাকবে।’
কেউ কেউ বলে বেড়াচ্ছেন, সব কওমী মাদরাসায়তো এমন সিদ্ধান্ত আগে থেকেই আছে ; অতএব এটিও গতানুগতিক একটি সিদ্ধান্ত, সঙ্কট কেটে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
বিষয়টিকে অত সহজ ভাবলে চলবে না। হাইআতুল উলইয়া সরকার স্বীকৃত এবং আইন দ্বারা বিধিবদ্ধ একটি প্রতিষ্ঠান। এর যে কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তায়। অতএব মাদরাসা সমূহের ঘরোয়া সিদ্ধান্তের সঙ্গে এর তুলনা করাটা হবে বোকামী।
এই সিদ্ধান্তের বেলায় হাইআ একটি ‘চূড়ান্ত’ শব্দও ব্যবহার করেছে।
তাই যদি হয় তাহলে এদেশ থেকে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের নামে ইসলামী সংগঠনগুলো নিষিদ্ধের যে আওয়াজ বেশকিছু দিন ধরে উচ্চারিত হচ্ছে, সে কাজটিই সহজ করে দিবে হাইআ।
এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে আরো যেসব সঙ্কট তৈরি হবে, তা হলো; এ দেশের প্রায় সবগুলো ইসলামী সংগঠন অস্তিত্ত্ব সংকটে পরবে।
স্বাধীনতা পরবর্তী বিশেষ করে বিগত চার দশকে যেসব ইসলামী সংগঠন বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাত পাড় হয়ে যতটুকুই বিকাশ লাভ করেছে, সেই ধারা থেমে যাবে।
আর ইসলামী সংগঠনগুলো যদি চ্যালেঞ্জের মূখে কাজ অব্যাহত রাখতে চায়, তাহলে দেশের হাজার হাজার আলেম বেকার হয়ে যাবেন এবং হয়রানির শিকার হবেন।
কারণ, দেশের সবগুলো কওমী মাদরাসার শিক্ষক কে কোন দল করেন, স্থানীয় থানায় তা সবই রেকর্ড আছে।
সবচেয়ে বড় যে সংকট দেখা দিবে ; যা রাষ্ট্র, সরকার এবং মাদরাসা সবার জন্যেই উদ্বেগের তাহলো, কওমী মাদরাসাগুলোকে ভয়ঙ্কর উগ্রবাদীরা গ্রাস করে নিতে পারে। যাদেরকে হাইআ, বেফাক, পীর, বুজুর্গ,ওস্তাদ কারো পক্ষেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।
এখনতো ইসলামী সংগঠনগুলো সবার কথাই শুনে, সরকারের সঙ্গেও বিভিন্ন বিষয়ে ডায়ালগ করতে চায়। তখ কিন্তু আলোচনার জন্যে আগা-মাথা খুজে পাওয়া মুশকিল হবে।
আসলে সরকারকে এবং কওমীর মুরুব্বীগণকে সমস্যার মূলে যেতে হবে।
বর্তমানে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে, তা কিন্তু রাজনৈতিক কারণে নয় বরং গঠনমূলক রাজনীতির অভাবে।
অতীতেও কোন নিয়মতান্ত্রিক ইসলামী রাজনৈতিক দলের কারণে দেশের কোন কওমী মাদরাসায়ই কোন সঙ্কট তৈরি হয়নি।
স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত সঠিক ধারার কোন ইসলামী রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক কর্মসূচীর কারণে কওমী মাদরাসার একজন ছাত্র শিক্ষকও মারা যায়নি, একজনেরও ফাঁসি হয়নি। হয়রানীমূলক মামলা, জেল হাজত হলেও কওমী মাদরাসার একজন ছাত্র শিক্ষকও এ পর্যন্ত রাজনীতি করার কারণে কনভিক্টেট হয়নি।
অপরদিকে অরাজনৈতিক কারণে এ পর্যন্ত কওমী মাদরাসার অনেক ছাত্র শিক্ষক জীবন দিয়েছেন, ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলেছেন, যাবতজীবন কারারুদ্ধ হয়েছেন।
এবারও হাটহজারীতে যারা জীবন দিয়েছেন, বি বাড়ীয়ায় যেসব মাদরাসার ছাত্র জীবন দিয়েছেন, তারা একজনও কোন ইসলামী রাজনৈতিক দলের কর্মী নয়।
এমনকি হাটহাজারীতে যারা শায়খুল ইসলাম আহমদ শফি রহ. -এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল এবং তাঁর অন্তিম মূহুর্তে চরম অমানবিকতা করেছিল, তারাও কেউ কোন ইসলামী রাজনৈতিক দলের কর্মী নয়।
হাইআতুল উলয়ার বিরাজনীতিকরণ উদ্যোগে এই উগ্র শ্রেণিটি এবং তাদের আবেগী অপরিনামদর্শী অনুসারীরাই অতি উল্লসিত।
হতে পারে কোন রাজনৈক সংগঠনের উচ্চাভিলাষী কেউ নির্বুদ্ধিতা ও অপরিনামদর্শিতার কারণে এই উগ্র গোষ্ঠীকে নিয়ে দেশে কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলার দিবাস্বপ্ন দেখেছিল। তাই বলে কোন ব্যক্তিবিশেষের অন্যায়ের দায় সবগুলো ইসলামী দল ভোগ করবে কেন?
এদেশের ইসলামী সংগঠনগুলোতে মতপার্থক্য থাকতে পারে, ছোটখাট ভুলভ্রান্তিও থাকতে পারে কিন্তু তারা তুলনামূলক বিবেচনায় সেকুলার সংগঠনগুলোর চেয়ে অনেক বেশি শান্তিপ্রিয়।
কওমী মাদরাসার ছাত্র শিক্ষকগণও তুলনামূলক ধৈর্যশীল ও আদর্শ নাগরিক। দেশে শান্তি, সৌহার্দ্য ও স্থিতিশীল সম্প্রীতি রক্ষায় তাদেরও অবদান রয়েছে।
একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতিগঠনের মূল স্রোতধারা থেকে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আস্থাভাজন প্রকৃত ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক প্রতিনিধিদেরকে দূরে থাকতে বাধ্য করা কারো জন্যই মঙ্গলজনক নয়।
অতএব, আমি কওমির অভিবাবক হাইআতুল উলয়ার সুবিবেচক অভিবাবকদের কাছে বিষয়টির গভীরতা ও বাস্তবতা বিবেচনা করে আরো সতর্কভাবে অগ্রসর হওয়ার অনুরোধ করছি।
আর সরকারের প্রতিও সমস্যার মূল তালাশ করার আহবান জানিয়ে বলবো, সংবিধান অনুযায়ী সকল শ্রেনির নাগরিকের প্রতি ইনসাফ বজায় রাখুন।
কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং আলিয়া মাদরাসার ছাত্র শিক্ষকরা যদি শত-সহস্র সহিংসতার পরও রাজনীতি করতে পারে, তাহলে তুলনামূলক নিরীহ কওমি মাদরাসার ছাত্র শিক্ষকরা রাজনীতি করতে পারবেন না কেন?
হাইআতুল উলয়ার নেতৃবর্গকে যদি সরকার সেলফ সেন্সরশিপে বাদ্ধ করে, তাহলে তা সরকারের জন্য অসততার ইতিহাস হয়ে থাকবে।
লেখক
যুগ্ম-মহাসচিব, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ