কক্সবাজারের চকরিয়ায় পাহাড়ি ঢল, অবিরাম বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে বেড়িবাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে ১৫ টি হ্যাচারিসহ শতাধিক চিংড়ি ঘের ও ৩৯ একর ফসলি জমি। ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)’র উদাসীনতার কারণে বেড়িবাঁধগুলো সঠিক সময় মেরামত না করায় গত তিন-চার বছর ধরে বার বার ক্ষতির মুখে পড়ছেন তারা। তবে পাউবো’ বলছে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে বেড়িবাঁধ দ্রুত মেরামতের ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নদীর জোয়ারের পানিতে হ্যাচারি ও ফসলি জমি তলিয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার ৬০ হাজার কৃষক। উপজেলায় প্রায় ১০২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে কতটুকু ভেঙেছে তা এখনো জানে না পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এছাড়া টানা ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকায় আরও পাহাড় ধ্বসের আশঙ্কা করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
উপজেলার বিএমচর ইউনিয়নের কুরিল্লাকুম, কইন্নারকুম এবং কোনাখালী ইউনিয়নের মরংঘোনা পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে আরো এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এছাড়া ইলিশিয়া টেকচিরা বাঁধ অতিক্রম করে পানি প্রবেশ করছে বিভিন্ন এলাকায়। অনেক রাস্তা পানির চাপে ভেঙে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। চকরিয়া উপজেলার কাকারা, সুরাজপুর—মানিকপুর, বমুবিলছড়ি, লক্ষ্যারচর, ফাঁসিয়াখালী, কৈয়ারবিল, হারবাং, বরইতলী, ডুলাহাজারা, খুটাখালী, চিরিংগা, সাহারবিল, পূর্ব বড় ভেওলা, বিএমচর, কোনাখালী, ঢেমুশিয়া, পশ্চিম বড় ভেওলা ও বদরখালী গ্রামের পর গ্রাম কোমর সমান পানিতে তলিয়ে গেছে।
প্রেজেন্ট নিউজের চকরিয়া সংবাদ দাতা সরেজমিনে খোঁজ খবর নিয়ে জানান, পাহাড়ি ঢল ও টানা ভারি বর্ষণে চকরিয়া উপজেলার অধিকাংশ ইউনিয়ন এবং পৌরসভা পানিতে ভাসছে। এই অবস্থায় অন্তত ২ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভেঙে পড়েছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। এদিকে মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা উজানের পানির প্রবল তোড়ে কয়েকটি স্থানে ভেঙে গেছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধও। এতে উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে নতুন করে পানি ঢুকছে। ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় ভয়াবহ পাহাড় ধ্বসের শঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
জরুরি প্রয়োজনে মানুষ নৌকায় করে যাতায়াত করছে। মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা উজানের পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ওপর টানা বর্ষণ অব্যাহত থাকায় মানুষের মাঝে আতঙ্কও ছড়াচ্ছে। দুই উপজেলার ফসলি জমিও বানের পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেকস্থানে ভেসে গেছে ঘের ও পুকুরের মাছ।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন থেকে চকরিয়া উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৭২ টন জিআর চাল। সেই চাল সমবণ্টন করে চকরিয়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিটি ইউনিয়নের বিপরীতে চার টন করে ডিও ছাড় করা হয়েছে। যাতে পানিবন্দি হয়ে পড়া লাখো পরিবারের মাঝে জিআর চাল বিতরণ শুরু করা যায়।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ শামসুল তাবরীজ বলেন, একদিকে ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকা এবং মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা উজানের পানিতে উপজেলার সবকটি ইউনিয়নে বন্যা দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নিরাপদ আশ্রয়ে যাতে মানুষ চলে যায় সেজন্য মাইকিং করা হচ্ছে। পাহাড় ধসের আশঙ্কা থাকায় জনগণকে সচেতন করা হচ্ছে। পাশাপাশি উপকূলীয় এলাকার সব সুইচ গেটের কপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। যাতে পানি নদীতে দ্রুত নেমে যেতে পারে।
উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী বলেন, ১৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার সমন্বয়ে চকরিয়া উপজেলায় টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট বন্যায় প্রায় এলাকা বানের পানিতে নিমজ্জিত। বরাদ্দকৃত খাদ্য সামগ্রী প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হওয়ায় জেলা প্রশাসকের কাছে অতিরিক্ত খাদ্য সামগ্রীর জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বিএমচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বিএমচর ইউনিয়নের কুরিল্লাকুম,কইন্নারকুম ভাঙা বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য আবেদন করেও পাউবোর সাড়া মিলছে না। তবে আমরা সবাই ব্যক্তিগতভাবে মিলেমিশে সাদামাটাভাবে রাতভর কাজ করে বেড়িবাঁধ দ্রুত সংস্কার করেছি। কারণ বেড়িবাঁধ দ্রুত সংস্কার করা না হলে আরও প্রায় ২৭ হাজার মানুষ বিপদে পড়বে। এছাড়া মানুষ বালির বস্তা দিয়ে রাস্তা রক্ষার জন্য চেষ্টা করছে।
তিনি আরও বলেন, ২০১৭ সালের প্রলঙ্করী বন্যায় কুরিল্লাকুম বেডিবাঁধ ভেঙে গিয়েছিলো তখন বেডিবাঁধে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে ১০ দিনে কাজ করে পুনঃসংস্কার করা হয়েছিলো। দ্বিতীয়বার বন্যা থেকে কাঁচা বাঁধকে রক্ষার জন্য দুটি যন্ত্র (স্কেলেটর)নিয়ে কাজ করা হয়েছিলো।
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড’র (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী বলেন, জেলায় বেড়িবাঁধ রয়েছে ৫৯৫ কিলোমিটার। চকরিয়ায় উপজেলায় প্রায় ১০২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে কিন্তু কতটুকু ভেঙেছে তা আগামী কয়েক দিনে মধ্যে জানা যাবে। এখনও পানি ভয়াবহ বিপদ সীমা অতিক্রম করছে। তাই কতটুকু বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে জানা যাচ্ছে না। এখন জোয়ারের পানিতে বন্দী উপকূলের প্রায় এক লাখ ১৭ হাজার মানুষ।
তিনি আরও বলেন, পাউবো থেকে চকরিয়া বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ এলে আগামী অক্টোবর- নভেম্বরে ভাঙা বাঁধের সংস্কার শুরু হবে। তবে জোয়ারের পানি ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ভাঙা বেড়িবাঁধের সংস্কার কাজ শুরু হবে।