আহসান শেখ:
আজ ২০ সফর। শিয়া সম্প্রদায়ের নিকট এটা আরবাঈন বা চেহলুম/চেহলাম(চল্লিশা) এর দিন হিসেবে পরিচিত। মূলত হিজরি বছরের প্রথম মাস মহররমে পবিত্র আশুরা ও কারবালার ঘটনার ৪০ দিন পরে হিজরি বছরের দ্বিতীয় মাস সফরে এই আরবাঈন( চল্লিশা) পালন করে ১২ ইমামী শিয়া সম্প্রদায়। এর মাধ্যমে শিয়া সম্প্রদায়ের কারবালার ঘটনার স্মরণে শোক পালনের আনুষ্ঠানিকতার সমাপ্তি হয়ে থাকে। যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদায় এই আরবাঈন পালন করেন শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা।
শিয়াদের রেডিও ও টিভি চ্যানেলে আরবাঈনে বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও শিয়া সম্প্রদায় আরবাঈন পালন করছে। তবে আহলে সুন্নাহর অনুসারী বা সুন্নি মুসলিমরা এই আরবাঈন চল্লিশা পালনকে বিদাত ও নাজায়েজ মনে করে এগুলোকে নিরুৎসাহিত করে।
প্রিয়নবী মুহাম্মদ সাঃ এর নাতি দৌহিত্র হযরত হুসাইন রাদিআল্লাহু আনহু এর শাহাদাতের চল্লিশতম দিন উপলক্ষে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিয়া সম্প্রদায়ের নাজাফ হয়ে কারবালার পথে পদযাত্রা করাকেই আরবাঈন হিসেবে গন্য করা হয়। আর তাই আরবাঈনে বড় ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতা ইরাকের নাজাফ(যেখানে ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী রাঃ সমাহিত) ও কারবালায় এবং ইরানে হয়ে থাকে। শিয়া সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে এটা সৌদি আরবের মক্কায় হজের পরে তাদের দ্বিতীয় ধর্মীয় তীর্থযাত্রা সমাবেশ। আরবাঈন উপলক্ষে আরবাঈনের ১৫দিন আগে থেকেই ইরাকের নাজাফে আলী রাঃ এর মাযার/সমাধির দিকে শিয়া সম্প্রদায়ের লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম হতে থাকে। সেখানে তারা হযরত আলী রাঃ এর সমাধি মাযারে জিয়ারত, ইবাদত বন্দেগি, শোক মজলিস করে ও বিশ্রাম নেয়।
ইরাকের পাশাপাশি ইরান, সৌদি-আরব, কুয়েত, বাহরাইন, লেবানন, ওমান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, আজারবাইজান, ব্রিটেন
যুক্তরাজ্য,ফ্রান্স,ইটালি,নাইজেরিয়া,তানজানিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশ থেকে আগত শিয়া সম্প্রদায়ের অনেক লোকেরা গ্রুপ কাফেলা/মাওকিব সহকারে এই আরবাঈনে ছুটে আসেন। পরে আস্তে আস্তে নাজাফ থেকে কারবালার পথে রওনা দেয় এবং ১৮-২১ সফর কারবালায় অবস্থান করে এবং সেখানে বিশ্রাম নেয় ও ইবাদত বন্দেগি করে ।শিয়াদের পাশাপাশি অনেক সুন্নি ও সুফি মুসলিমরা এবং অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরা তথা খ্রিস্টান,হিন্দু,বৌদ্ধ,ইহুদি,শিখ,দ্রুজ ইত্যাদি ধর্মাবলম্বী অনেকেই এই আরবাঈনের যাত্রায় শরীক হয়। এই চারদিন কারবালায় শিয়া সম্প্রদায়ের আরবাঈনের আনুষ্ঠানিকতা ও শোক তাজিয়া মিছিল হয়ে থাকে,সেখানে অবস্থানরতদের জন্য তবারক খাবারের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে । এবারও ইরাকের কারবালায় আরবাঈনে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশ হওয়ার খবর শোনা গিয়েছে । (সূত্র-শিয়া ওয়েভস,আহলুলবাইত নিউজ এজেন্সি,প্রেসটিভি,আল ইরাকিয়া নিউজ,সাহার উর্দু,সামা নিউজ ও পার্সটুডে)
তবে যাদের ইরাকে যাওয়ার সুযোগ সামর্থ্য হয় নি তারা নিজ নিজ দেশে শিয়া মসজিদ ও ইমামবাড়ায় আরবাঈন চল্লিশা পালন করে শিয়ারা। ইরাকের পাশাপাশি ইরানের রাজধানী তেহরান,কুম,শিরাজ,মাশহাদসহ ইরানের ছোট বড় বিভিন্ন জেলায় এলাকায় আরবাঈন পালন করে শিয়ারা।তেহরানের ইমাম খোমেনী হুসেইনিয়া/ইমামবাড়ায় ইরানে শিয়াদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনীর উপস্থিতিতে আরবাঈন চল্লিশায় শোক মজলিস মাহফিল ও নওহা মাতম মরসিয়া হয়ে থাকে।
লেবাননের রাজধানী বৈরুতসহ অনেক এলাকায় শিয়ারা আরবাঈন চল্লিশা পালন করেছে।বিশ্বের অন্যতম সশস্ত্র শিয়া মিলিশিয়া হিজবুল্লাহ এর উদ্যোগে সেদেশের অনেক শহরে আরবাঈন চেহলুম উপলক্ষে সমাবেশ ও মাহফিল করেছে,যেখানে হিজবুল্লাহ নেতা সৈয়দ হাসান নাসরুল্লাহ গুরুত্বপূর্ণ ভাষন দেন। বড় পর্দায় প্রজেক্টরের মাধ্যমে হিজবুল্লাহ নেতা সৈয়দ হাসান নাসরুল্লাহর ভাষণ বক্তব্য প্রচারিত হয়।
এদিকে বাংলাদেশেও শিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারীরা আরবাঈন বা চেহলাম চল্লিশা পালন করেছে। শুক্রবার ১৬ সেপ্টেম্বর (১৯ সফর হিজরী) বিকাল তিনটায় রাজধানী ঢাকার সূত্রাপুর ফরাশগঞ্জের বিবিকা রওজা ইমামবাড়ায় শিয়াদের চেহলাম স্মরণে মাহফিল শোক মজলিস আয়োজন করে । পরে সেখান থেকে আরবাঈন চেহলাম স্মরণে শোক তাজিয়া মিছিল করে যা সূত্রাপুর আর এম দাস রোড, হেমেন্দ্র দাস রোড, শিংটোলা,প্যারিদাস রোড বাংলাবাজার হয়ে বিবিকা রওজা ইমামবাড়ায় গিয়ে শেষ হয়। এর পাশাপাশি রাজধানীর ঐতিহাসিক হোসেনী দালান ইমামবাড়ায় আরবাঈন চেহলাম এর আগের দিন শুক্রবার রাতে শিয়াদের শোক মজলিস হয়, সেখানে শিয়ারা কারবালার ঘটনার স্মরণ করেন ও মাতম মরসিয়া করেন।
শনিবার হোসেনী দালানে শিয়াদের আরবাঈন চল্লিশা উপলক্ষে শোক তাজিয়া মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। পুরানা পল্টনে অবস্থিত শিয়া মসজিদ ও ইমামবাড়াতেও আরবাঈন চল্লিশা পালিত হয়েছে সেখানে শুক্রবার ১৬ সেপ্টেম্বর রাত আটটায় আরবাঈন চেহলাম উপলক্ষে শিয়াদের মাহফিল শোক মজলিস ও মাতম মরসিয়া হয় যেখানে শিয়া আলেম হাশেম আব্বাস কারবালার ঘটনা ও চেহলাম নিয়ে আলোচনা ও মাসায়িব পাঠ করেন।
এর পাশাপাশি রাজধানীর মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদ,মগবাজার ইমামবাড়া ও মিরপুরের শিয়া মসজিদ ও ইমামবাড়ায় আরবাঈন চেহলাম উপলক্ষে শোক মজলিস,জিয়ারতে আরবাঈন নামক ওয়াজিফা দোয়া পাঠ ও শোক তাজিয়া মিছিল এর আয়োজন করে শিয়ারা। একই রকম আনুষ্ঠানিকতা ঢাকার বাইরে গাজীপুর,ফরিদপুর,চট্টগ্রামের হালিশহর,খুলনার আলতাপোল লেন ও খালিশপুরে, যশোর,সাতক্ষীরা,রাজশাহী এবং মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় বসবাসরত শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা আরবাঈন চল্লিশা পালন করে।
শনিবার এবং রবিবার ১৮ সেপ্টেম্বর (২১ সফর) খুলনার আলতাপোল লেনে শিয়া আলেম সৈয়দ ইব্রাহিম খলিল রাজাভীর মারকায দেরাসাত আঞ্জুমান এ পাঞ্জাতনী শিয়া মসজিদ ও ইমামবাড়ায় আরবাঈন চেহলাম পালনে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। যেখানে শনিবার জিয়ারতে আরবাঈন পাঠ এবং বিশেষ শোক মজলিস ও নওহা মাতমে অংশগ্রহণ করেন শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা। রবিবার দুপুরে সেখানে বিভাগীয় পর্যায়ে আরবাঈনের শোক মজলিস ও শোক মিছিল অনুষ্ঠিত হবে যা সন্ধ্যার আগেই শেষ হয়। এই শোক মিছিল খুলনার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহর এলাকায় প্রদক্ষিণ করেন।
পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ, করাচী, লাহোর,কোয়েটা,পেশোয়ার,রাওয়ালপিন্ডি,ফয়সালাবাদসহ অনেক জেলায় শিয়ারা আরবাঈন চল্লিশা উপলক্ষে মাহফিল শোক মজলিস ও তাযিয়া মিছিল এর আয়োজন করেছে,লাহোরে নিসার হাভেলিতে শিয়াদের আরবাঈন চল্লিশায় শোক মজলিস ও তাযিয়া মিছিল হয় । সূত্র: (সামা নিউজ ও নাইন্টি টু নিউজ 92News)
করাচীতে নিশতার পার্ক এলাকা ও আলী জিন্নাহর সমাধিসৌধ সংলগ্ন এলাকায় আরবাঈন চেহলামে শিয়াদের বড়ধরনের সমাবেশ ও তাজিয়া মিছিল আয়োজন করে যেখানে শেহেনশাহ নকভীসহ শিয়াদের অনেক ধর্মীয় নেতা আলেমরা উপস্থিত ছিলেন। যেসব এলাকায় আরবাঈন চেহলুম এর মিছিল সেসব এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক সার্ভিস বন্ধ রাখে সেদেশের প্রশাসন।
ভারতের দিল্লী,পশ্চিম্বঙ্গের কিছু এলাকায়,মুম্বাই,লাখনৌসহ অনেক এলাকায় শিয়ারা আরবাঈন চেহলাম উপলক্ষে শোক মজলিস ও তাযিয়া মিছিল এর আয়োজন করে। আফগানিস্তান,ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া,তানজানিয়া,যুক্তরাজ্য ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বসবাসরত শিয়ারাও আরবাঈন চেহলাম উপলক্ষে শোক মজলিস মাহফিল ও শোক মিছিলের আয়োজন করে। নাইজেরিয়ার কানো শহরে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা আরবাঈন উপলক্ষে র্যালী করে।