‘সূর্য অস্ত গেল, সূর্যদেব কোন দেশে—
এখানে সন্ধ্যা নামল,
শীতের আকাশে অন্ধকার ঝুলছে শূকরের চামড়ার মতো,
গলিতে গলিতে কেরোসিনের তীব্র গন্ধ
হাওয়ায় ওড়ে শুধু শেষহীন ধূলোর ঝড়;
এখানে সন্ধ্যা নামল শীতের শকুনের মতো।’
কবি সমর সেনের কবিতার মতই ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার জনগন যখন বৃটিশ শকুনের হাত থেকে পাকি শকুনের হাতে পরে; তখন বাঙালি অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকলেও পশ্চিমা পাক শাসকগোষ্ঠী আমাদের শোষণ করতে শুরু করে। সীমাহীন বৈষম্যের শিকার হতে থাকে এদেশে খেটে খাওয়া মানুষজন। পাকি শাসকগোষ্ঠীর শোষণের হাত থেকে বাঙালি জাতিকে রক্ষা করতে, অভাবী ভুখানাঙা ও দিন মজুরশ্রেণির মাটির মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায়, গণতন্ত্র, জাতীয়তা, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার উপর ভিত্তি করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ এবং সোনার বাংলাকে কণ্ঠ থেকে বাজেয়াপ্ত করার যে নীল নকশা তা প্রতিহত করতে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি সূর্যদেব রূপে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, “১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি তারিখে ফজলুল হক মুসলিম হলের এ্যাসেম্বলি হলে এক সভা ডাকা হল, সেখানে স্থির হল একটা ছাত্র প্রতিষ্ঠান করা হবে। যার নাম হবে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। নইমউদ্দিনকে কনভেনর করা হল। অলি আহাদ এর সভ্য হতে আপত্তি করল। কারণ সে আর সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান করবে না। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নাম দিলে সে থাকতে রাজি আছে। আমরা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম এবং বললাম, ‘এখনও সময় আসে নাই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দেশের আবহাওয়া চিন্তা করতে হবে। নামে কিছুই আসে যায় না। আদর্শ যদি ঠিক থাকে, তবে নাম পরিবর্তন করতে বেশি সময় লাগবে না।’ —————————————————————————————————-
ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠান গঠন করার সাথে সাথে বিরাট সাড়া পাওয়া গেল ছাত্রদের মধ্যে। এক মাসের ভিতর আমি প্রায় সকল জেলায়ই কমিটি করতে সক্ষম হলাম। যদিও নইমউদ্দিন কনভেনর ছিল, কিন্তু সকল কিছুই প্রায় আমাকেই করতে হত। একদল সহকর্মী পেয়েছিলাম, যারা সত্যিকারের নিঃস্বার্থ কর্মী।”
একঝাঁক সূর্যবিজয়ী স্বাধীনতাপ্রেমী নিঃস্বার্থ কর্মী এবং বঙ্গবন্ধুীর প্রেরণা ও পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ; ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ ও ৬৪ সালের শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ছয় দফার আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, সর্বোপরি পাক শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রলীগ বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের প্রায় ১৭ হাজার নেতা-কর্মী শহীদ হন। ১৯৭২ সাল থাকে ১৯৭৫ কালপর্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনের সংগ্রামে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ঠিক এ কারণেই বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালি জাতির ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাস।’
এশিয়া মহাদেশের ‘বৃহত্তম’ ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ চলার পথ সবসময় কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। জন্মলগ্ন অশুভ শক্তির হত্যা ও সন্ত্রাসের রাজনীতির লক্ষবস্তু ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন,
“আওয়ামী লীগ গড়ে ওঠার পূর্ব পর্যন্ত একমাত্র ছাত্রলীগই সরকারের অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত এবং জনগণ ও ছাত্রদের দাবি দাওয়া তুলে ধরতো। ছাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের নেতা ও কর্মীদের অনেক অসুবিধা ভোগ করতে হয়েছে। মুসলিম লীগ সরকার ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠানকে খতম করার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করে নাই।”
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পরে দেশের গভীর সংকটকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তার হাজার হাজার নেতাকর্মী নিয়ে মৃত্যুভয় উপেক্ষা দেশমাতৃকাকে রক্ষা করার জন্য রাজপথে নেমে এসেছে। ৭৫’ পরবর্তী খুনি মোস্তাক, জিয়া সরকার, ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার এরশাদ সরকার, ১/১১ সেনাসমর্থিত অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার তথা প্রতিটি অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। প্রতিটি আন্দোলনে শত শত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে অকথ্য জেল-জুলুম আর অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও ধর্মনিরপেক্ষ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বার বার ফিরে এসেছে, বার বার ফিরে আসবে। শেষে লাখো তারুণ্যের প্রাণের উচ্ছ্বাস, আবেগ আর ভালোবাসার সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭৪তম জন্মদিনে কবি সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার সাথে মিল রেখে বলতে হয়;
যখনই পাকি শকুন নেমে আসবে এই সোনার বাংলায়;
যখনই সোনার বাংলার স্বপ্ন লুট হয়ে যাবে পাক দালালদের হাতে;
তখনই ছাত্রলীগ আসবে ফিরে বাংলার নূরলদীন হয়ে।
দিবে ডাক, “জাগো বাহে!কোনঠে সবায়?”
লেখক –
মোঃ আলিফ হাসান অভি
ক্রীড়া সম্পাদক, ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।