সুবর্ণ জয়ন্তীকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদী কর্মসূচিতে সংঘটিত সরকারের পেটোয়া বাহিনী কর্তৃক হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করছি। আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হলে, সবার আইন মানার সংস্কৃতি গড়ে তোলা একান্ত জরুরি।
চলমান হত্যাকান্ডের বিষয় পত্রিকায় যে রিপোর্টগুলো দেখলাম তাতে দেখা গেছে, পুলিশ বাহিনী শুরু থেকেই ঔদ্ধত্য ছিল। অস্ত্র হাতে নিয়ে মারমুখী অবস্থানে। প্রশ্ন রাখতে চাই তৌহীদী জনতা কি করেছে? তাতে সরাসরি গুলি করার প্রয়োজন দেখা দিলো কেনো?
আর পুলিশের নিয়ম আছে গুলি করার প্রাথমিকভাবে- আত্মরক্ষার্থে, হাটুর নিচে যাতে সে সামনে আগ্রসর হতে না পারে। পুলিশ রেগুলেশনের ১৪৩ প্রবিধানে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ কর্তৃক সভা-সমাবেশ করার অনুমতি প্রদানের একটি বিধানের কথা বলা হচ্ছে যেটি মূলত পুলিশ আইনের ৩০ (৩) ধারার মূল বক্তব্য।
যেহেতু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সভা-সমাবেশ করা জনগনের দাবীর প্রতিফলন তাই পুলিশের অনুমতির প্রয়োজন ছিল না।
আর সরকারের চাপিয়ে দেয়া অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেহেতু প্রতিবাদ হচ্ছিল তাই প্রশাসনের অনুমতি নেওয়ার প্রশ্নও অবান্তর ছিল।
এই সমাবেশ আমাদের সাংবিধানিক অধিকার।
বাংলাদেশে সমাবেশ-বিক্ষোভ করা অবৈধ ?
প্রবিধান ১৫৩ (গ) (১) অনুসারে, জনতার উপর গুলিবর্ষণের আদেশ একটি চরম ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং এ পদক্ষেপ গৃহীত হবে সকল ব্যবস্থা শেষে যখন জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য তা একান্তভাবে অপরিহার্য হয়ে পড়ে বা যখন একজন ম্যাজিস্ট্রেট, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা এ ধরনের অফিসারের উচ্চ পদমর্যাদার অফিসার বিবেচনা করেন যে, অন্য কোনোভাবে উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে ছত্রভঙ্গ করা সম্ভব নয় কেবল তখনই ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে।
প্রবিধান ১৫৩ (গ) (২) অনুসারে, জনতার উপর গুলিবর্ষণের আদেশ প্রদানের পূর্বে কি কোন ম্যাজিস্ট্রেট ছিল?
কিংবা কোনো ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত না থাকলে পুলিশ দলের অধিনায়ক পুলিশ অফিসার দাঙ্গাকারীদের পূর্ণাঙ্গ এবং অনেকবার সতর্ক বাণী প্রদান করবেন। পুলিশ কি তা করেছে?
উপরোক্ত প্রবিধান থেকে দেখা যায় যে, গুলি করার পূর্বে অনেকগুলো বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হয়– গুলিবর্ষণের সিদ্ধান্ত একটি ‘চরম’ ও ‘শেষ’ ব্যবস্থা এবং ‘অনেকবার’ সতর্কবাণী প্রদান করবেন।
এখানে ‘অনেকবার’ শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে সতর্কবাণী প্রদান করাকে সত্যিকারের সতর্কবাণী প্রদান করা বোঝানো হয়েছে, যাতে সমাবেশকারীরা বুঝতে পারেন যে, তাদের শারীরিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যদি তারা সরে না যান।
তাই এই সতর্কবাণী প্রদান করার বিধান কেবল নিয়ম রক্ষার জন্যে নয়। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে জেনেছি, মিছিলের ঘটনায় গুলিবর্ষণের আগে পুলিশ কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক কোনো প্রকার সতর্কবাণী প্রদান করা দূরে থাক, সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন বলেও মনে হয় না। তাহলে কার নির্দেশে পুলিশ গুলি চালিয়েছে?
প্রবিধান ১৫৩ (গ) (৩) এ বলা হয়েছে, দাঙ্গা দমনে অথবা দাঙ্গাকারী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার কাজে নিয়োজিত সকল পদমর্যাদার পুলিশ সদস্য গুলিবর্ষণের পূর্বে একজন ম্যাজিস্ট্রেট, বা তার থেকে ঊর্ধ্বতন পদমর্যাদার কোনো পুলিশ অফিসারের আদেশের জন্য অপেক্ষা অবশ্যই করবেন।
এখানেও উল্লেখ্য যে, ম্যাজিস্ট্রেট, বা তার থেকেও উপরের কোনো পুলিশ কর্মকর্তার আদেশের জন্য অপেক্ষা করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
আমার জানামতে, এই বিধান নিকট অতীতের প্রায় সকল গুলিবর্ষণের ঘটনার ক্ষেত্রেই মানা হয়নি।
কোনো সংবাদমাধ্যম এ পর্যন্ত গুলিবর্ষণের ঘটনার পর পুলিশ তাদের করণীয় কর্তব্য পালন করেছে কিনা সে সম্পর্কে কোনো রিপোর্ট প্রকাশ করেনি। থানা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সে রকম কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, পুলিশ এখন পর্যন্ত সে রকম কোনো প্রতিবেদন প্রস্তুত কিংবা প্রেরণ করেননি।
পুলিশ কর্তৃক এরূপ প্রতিবেদন প্রেরণ করার বিধানের পাশাপাশি পুলিশ কর্তৃক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের পর নির্বাহী তদন্তেরও বিধান রাখা হয়েছে।
পুলিশ রেগুলেশনের প্রবিধান ১৫৭ (ক) অনুসারে, যখনই পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে থাকে, তখনই গুলিবর্ষণ যুক্তিসঙ্গত হয়েছে কিনা এবং এ প্রবিধানসমূহ যথাযথভাবে প্রতিপালিত হয়েছে কিনা তা নির্ধারণের জন্য যত শীঘ্র সম্ভব নিম্নোক্তদের দ্বারা পূর্ণাঙ্গ নির্বাহী তদন্ত অনুষ্ঠিত হবে–
(১) যদি একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, একজন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, একজন পুলিশ সুপার, একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গুলিবর্ষণের সঙ্গে জড়িত থাকেন, তবে কমিশনার কর্তৃক তদন্ত হবে;
(২) যদি একজন [মহকুমা] ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী পুলিশ সুপার গুলিবর্ষণের সঙ্গে জড়িত থাকেন, তবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, একজন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক তদন্ত হবে;
(৩) জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, একজন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট অথবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক মনোনীত একজন ম্যাজিস্ট্রেট তদন্ত করবেন।
এই তদন্তের সময় কোনো পক্ষের আইনজীবী কর্তৃক প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ নেই, তবে যদি কোনো পুলিশ অফিসারের আচরণ বিচার্য বিষয় হয় তবে তাকে প্রশ্ন করা ও সাক্ষীদের জেরা করা এবং মৌখিক বা লিখিতভাবে বিবৃতি প্রদানের অনুমতি দেওয়া যাবে বলে উল্লেখ আছে [প্রবিধান ১৫৭ (ঙ)]।
প্রবিধান ১৫৭ (চ) অনুসারে, অনুসন্ধান শেষ হবার পর অনুসন্ধানকারী অফিসার যথাযথ মাধ্যমে সরকারের নিকট প্রতিবেদন প্রেরণ করবেন এবং ইন্সপেক্টর জেনারেলের নিকট পেশ করার জন্য একটি অনুলিপি পুলিশ সুপার বা রেঞ্জের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেলের নিকট হস্তান্তর করবেন।
আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না যে উপরোক্ত আইনি বিধানসমূহ অনুসরণ করা হয়েছে কিনা।
বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের জানার অধিকার রয়েছে।
আমাদের ছোট ভাইয়েরা যখন পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছে, আহত হয় তখন এটি জানা আমাদের অধিকার বটে।
পুলিশ, ছাত্রলীগ আর ভ্রষ্টদের আঘাতে যখন আমার ভাইটি যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে তখন এটি জানা আমার সাংবিধানিক অধিকার। আমি সেই সাংবিধানিক অধিকারের দাবি নিয়ে বলছি– জবাব চাই কেন হাটহাজারি,বি-বাড়িয়া ও ঢাকায় ওলামায়ে কেরামের উপর গুলি চলল?
আমাদের দেশে মোটামুটি সকল আইনই লিখিত। কিন্তু আইন না মানার প্রবণতা কেবল সাধারণ মানুষ নয় বরং সর্বস্তরেই প্রোথিত।
সাধারণ জনগণ আইন না মানলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা আর প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী যদি সেটি না মানেন তাহলে মৃদু তিরস্কার– এই অসম আইনি বিধান ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকেই আছে।
আমাদের জাবাদিহিতা কেবল একপাক্ষিক।
আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হলে, সবার আইন মানার সংস্কৃতি গড়ে তোলা একান্ত জরুরি।
রাষ্ট্রের প্রত্যেকটা স্তম্ভ দলীয়করণের মাধ্যমে এমন অবস্থায় নিয়ে গেছে যে, মানুষের নিঃশ্বাস ফেলার অবশিষ্ট নাই।
আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি, আইয়ুবের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। আজকে আইয়ুব খান বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের এই অবস্থা দেখে লজ্জা পেতো।
সেই কারণে নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও কল্যাণ রাষ্ট্র দেখার জন্য একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিলো, যুদ্ধ করেছিল বাংলার মেহনতি মানুষ,স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ আজো আমরা পাইনি।
একাত্তরের সেই যুদ্ধ এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
দেশে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবানও জানাচ্ছি।
লেখক,
এম. হাছিবুল ইসলাম
শিক্ষানবিশ আইনজীবী,
জেলা ও দায়রা জজকোর্ট, ঢাকা
LL.B (Hon’s),LLM,DIU
hasibnil04@gmail.com