রণাঙ্গনের বীর শার্দুল কাদের সিদ্দিকী থেকে আলোচিত ইসলামিক নেতা মামুনুল হকের পক্ষ থেকে জামায়াতের কাছে বারবার আহ্বান করা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে তাদের অন্যায় রাজনীতির জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে। কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের আচরণ বড়ই বর্ণচোরা।
প্রথমত: তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকে তাদের বিশাল দূরদর্শিতা(!) হিসেবে এখনো মনে করে। আরেকটা কথা বলে, একাত্তরে নাকি সমস্ত আলেম ওলামা এবং কবি ফররুখের মত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গও জামায়াতের মতই রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধী ছিল! স্বাধীনতার অতিক্রান্ত ৫০ বছরেও যেই ব্যানার ব্যবহার করে তারা একটি দেশের মুক্তিসংগ্রামের সাংগঠনিক কর্মসূচি নিয়ে সর্বাত্বক বিরোধিতায় লিপ্ত ছিল; সেই ব্যানারটা পর্যন্ত তারা পরিবর্তনের প্রয়োজন উপলব্ধি করেনি! এতটাই হাই লেভেলের কনফিডেন্স তাদের! আদর্শের চেয়ে নেতৃত্ব ও ব্যানারের প্রতি জামায়াতের এই আবেগী প্রেম তাদের রাজনৈতিক আত্মহত্যার গর্ত খুঁড়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ যখন পাকিস্তানের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে লিপ্ত; তখন জামায়াত নেতৃবৃন্দ সাংগঠনিক সমস্ত শক্তি নিয়ে আল বদর আল শামস এবং শান্তি কমিটি গঠন করে সর্বতোভাবে বাংলাদেশ ঘোষণার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানিদের সাথে কাজ করেছে।
এখানে একটা কথা আরো সুস্পষ্টভাবে বলা প্রয়োজন, স্বাধীনতার প্রশ্নে রাজনৈতিক মতভিন্নতা এবং দলীয় অবস্থান জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধ থেকে বিরত থাকা কিংবা বিরোধিতা করা আর সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হওয়া এক কথা নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে স্বজাতির স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন নজির পৃথিবীতে নাই। তার উপর জামায়াত আবার এই স্বাধীনতাবিরোধীতাকে ইসলামাইজড করেছে। জামায়াত নেতাকর্মীদের দলান্ধতা এতই প্রকট যে, কোনটা স্বাধীনতার প্রশ্নে সামান্য একটা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আর কোনটা সাংগঠনিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে ময়দানে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে কাজ করা এই পার্থক্যটুকু তারা বুঝেনা অথবা স্বীকার করেনা।
এই যে জামায়াত তাদের একের পর এক নেতৃত্বকে হারালো, এর প্রথম দায়ভার তাদের। বিচারের এই কাঠগড়া জামায়াত নিজেই অবহেলায় অথবা আত্মম্ভরিতায় দিনে দিনে তৈরি করেছে। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সুযোগ পেয়েও তারা তাদের একাত্তরের কলঙ্কিত দলীয় নাম এবং নেতৃত্বকে পরিবর্তন করে নতুন রাষ্ট্রের উপযোগী স্বাধীনতা-উত্তর রাজনীতির পরিবর্তিত ধারা তৈরি করতে পারেনি। জামায়াত নেতাদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের পক্ষ থেকে এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল থেকে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আমি সে আলোচনায় যাচ্ছি না। ধরলাম জামায়াত নেতৃবৃন্দ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধকালীন কোন ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত ছিলেন না। এরপরও সাংগঠনিকভাবে তারা liability of responsibility এর জায়গা থেকে দোষী। এই দোষটা বর্তায় তাদের দল এবং স্বাধীনতাকালীন নেতৃত্বের উপর। যেহেতু এই দায় দায়িত্ব থেকে তারা পরবর্তীতে কোন দিন নিজেদের দায়মুক্ত করে নি। আমি বরং আশ্চর্যান্বিত হই মুক্তিযুদ্ধের পর কি করে তারা স্বাধীনতাকালীন নাম এবং নেতৃত্ব দিয়ে যুগের পর যুগ রাজনীতি চালিয়ে গেছে! উপরন্তু নিজেদের রাজনীতি ও নেতৃত্বের প্রতি এত বেশি ভরসা পেতেন তারা, তাদের নেতৃত্ব ও দলের নামটুকুও পরিবর্তনের প্রয়োজন মনে করেন নি কখনো। মুক্তিযুদ্ধে অন্যায় অথবা ভুল অবস্থানের জন্য তাদেরকে কখনো জাতির সামনে অনুতপ্ত হতে দেখা যায়নি। একাত্তরের মস্ত বড় ভুল, এবং স্বাধীনতা পরবর্তীতে সেই ভুলের উপর অটল থাকার দ্বিতীয় ভুলের খেসারত গোটা ইসলামপন্থীদেরকে বহন করতে হয়েছে।
বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতির প্রভাব বলয় তৈরি না হওয়া এবং ইসলামপন্থীদের সামাজিক পরবাসীতার জন্য বহুলাংশে জামায়াতের ৭১ কেন্দ্রিক রাজনীতির দায় রয়েছে। কল্পনা করুন, রাজনীতিতে নাটকে সিনেমায় যুগের পর যুগ ইসলামপন্থীদের যেভাবে রাজাকার এবং মুক্তিযুদ্ধের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ইসলামপন্থীদের সেটি ফেস করতে হত কিনা, যদি না জামায়াতের স্বাধীনতা বিরোধী অবস্থান না থাকতো। রাজাকার তখন যদি ইসলামপন্থীদেরকে লাগানো না যেতো আজকের ইসলামপন্থীরা রাজনীতি-সমাজ ও সংস্কৃতির মূলধারায় অবস্থান করতেন। অন্তত তাদের কে হীনমন্যতায় ভুগতে হতো না। ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর সামগ্রিক চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতো। জামায়াতের অভ্যন্তরে এই মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে প্রচুর বিতর্ক ছিল। কিন্তু তাদের সিনিয়র নেতৃত্ব এই মৌলিক প্রশ্নগুলোকে পাশ কেটে যেতে পেরেছে তাদের দলীয় স্বৈরতন্ত্রের কারণে।
স্বাধীনতা পরবর্তী জামায়াতী রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন নেতারাই ছিলেন সর্বেসর্বা। যুদ্ধাপরাধ বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত জামায়াতের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা একচেটিয়াভাবে বিতর্কিত প্রবীণ নেতাদের হাতে কুক্ষিগত ছিল। এ কারণে দলের নাম পরিবর্তন, নেতৃত্ব পুনর্গঠন এবং স্বাধীনতার বিপক্ষের সাংগঠনিক বিরোধিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে তারা একেবারেই ইচ্ছুক ছিল না। এই কাজগুলো যদি তারা করতে যেতেন তাহলে তারা দুইটা বিপদের সম্মুখীন হতেন। প্রথমত তাদের একাত্তরের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণ হতো এবং এর জন্য তাদেরকে একটি অপমানজনক স্বীকারোক্তি দিতে হতো।
দ্বিতীয়তঃ দলের ভিতরে পাকাপোক্ত করা ক্ষমতা এবং নেতৃত্ব তারা হারিয়ে ফেলতেন। দূরদর্শী জামায়াতের বিতর্কিত নেতৃবৃন্দ বুঝতে পেরেছিলেন অপরাধ কিংবা ভুল স্বীকার করে দলীয় পদ পদবী ছেড়ে দিলে তারা তখনই বিচারের মুখোমুখি হয়ে যেতে পারতেন। এবং সে সময় তারা দলের কর্তৃত্বে না থাকার কারণে দলীয় সাপোর্ট পেতেন না। এ কারণে তারা অতি স্বাভাবিক দুটি সহজ পথ ছেড়ে গোঁড়ামির পথ ধরলেন। বিনিময়ে যা হওয়ার তাই হয়েছে।
৭১ প্রশ্নে জামায়াত আর কখনো বিব্রত পরিস্থিতি থেকে আপন ইচ্ছায় বের হতে পারল না। কিন্তু বাংলাদেশে যতদিন থাকবে জামায়াতকে ততদিন এই প্রশ্নগুলো বারবার বিভিন্ন মহল থেকে ফেস করতে হবে। এর জন্য তাদের প্রয়োজন মগজধোলাইয়ের একটি পালটা বয়ান তৈরি করা। সেই প্রিভেন্টিভ বয়ান ধরেই স্বাধীনতা ও জামায়াত নিয়ে প্রশ্ন উঠলে উল্টো তারা ভারত ফোবিয়া এবং ভারতের ক্রমাগত আধিপত্য দিয়ে এখনো একাত্তরের সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত ও সর্বাত্মক কর্মসূচিগুলো কে সঠিক ছিল বলে জাস্টিফাই করে। আমার প্রশ্ন হল জামায়াত যদি মুক্তিযুদ্ধকে ফেস করতে অসম্মত হয়, তাহলে তারা কেন বিজয় দিবস পালন করে? মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দেয়? ‘স্বাধীনতা এনেছে স্বাধীনতা রাখবার’ মতো মিথ্যা কথাকে রাজনৈতিক স্লোগান বানায়?
কওমি ধারার রাজনৈতিক দলগুলো শুধুমাত্র একটি পূর্ব শর্ত দিয়ে থাকে। মওদুদীয়াত নিয়ে তাদের অনাপত্তির মীমাংসা।
এটা ঠিক কওমীদের সব অভিযোগ জাস্টিফাইড না। তারপরও মওদুদীয়াত মীমাংসায় তাদের বারবার বসার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু জামায়াত মঞ্চে ঐক্যের কথা বললেও মওদুদীয়াত মীমাংসায় তাদের আন্তরিকতা ছিল না। মওদুদীয়াত নিয়ে আপত্তি দু এক জায়গা থেকে উত্থাপিত ছিলনা যে এটিকে ইগনোর করতে হবে।কেউ কেউ বিদ্বেষও প্রতিহিংসাবশত মওদুদীয়াত নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে, এটা অনেকটা ব্যক্তিগত নিগ্রহের ক্ষোভ থেকে। কিন্তু মেইনস্ট্রিম ইসলামের প্রায় প্রত্যেকটি ধারা এবং উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ যে আপত্তি তুলেছে সে গুলোকে হিংসা প্রসূত আখ্যায়িত করে জামায়াত দাম্ভিকতা প্রদর্শন করেছে।
মরহুম গোলাম আজম সাহেব চরমোনাই এর সাথে এ সংক্রান্ত একটি সম্ভাব্য বৈঠককে “মোমবাতির সাথে সুর্যের বৈঠক হয় না” বলে নাকচ করে দিয়েছেন। খোদ আল্লামা সাঈদীর মত ব্যক্তি “কালো মানুষের ভিতর-বাহির দুটো কালো” বলে এই আপত্তির জায়গাগুলোতে নেগোসিয়েশনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন।
যেহেতু স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে জামায়াত সামগ্রিক ইসলামপন্থী রাজনীতির হেডমাস্টার, তাদেরকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে হলেও অবুঝকে সান্তনা দেয়ার মত হলেও মওদুদীয়াতের আপত্তির জায়গায় কওমীদের সাথে বসা প্রয়োজন ছিল। এক্ষেত্রে কিছু জায়গায় যদি তাদের পরাজয় মেনে নেয়ার অবস্থা হতো সেটা ও রাজনৈতিক স্বার্থে তাদের করা উচিত ছিল। এই আপাত পরাজয়ের পর ই আসতো জামায়াতের রাজনৈতিক বিজয় এবং চূড়ান্ত কর্তৃত্ব। এই জায়গাটাতে তারা উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে, কওমিরা কেন এক হয় না? জামায়াতকে বাদ দিয়ে তারা কেন রাষ্ট্র কায়েম করে না? এগুলো কেবল ছেলেমানুষি প্রশ্ন। জামায়াত কি এটা জানে না, কওমিরা নিয়ম তান্ত্রিক ক্ষমতার রাজনীতি করে না। ধর্মীয় ইস্যুতে তৌহিদী জনতার আন্দোলন ছাড়া তাদেরকে দিয়ে ক্ষমতার রাজনীতি অসম্ভব। তারা নিজেরাও কখনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ লালন করে না। জামায়াতের যেখানে ইসলামপন্থী রাজনীতিতে অভিভাবকত্বের উদারতা প্রদর্শন করা দরকার ছিল। এবং কিছু ক্ষেত্রে অযৌক্তিক আবদার মেনে হলেও আই ওয়াশিং মওদুদীয়াত ঘোষণার প্রয়োজন ছিল, সেখানে তারা কওমীদের চেয়ে আরো বড় ছেলেমানুষি করল। ফলে সাংগঠনিক সক্ষমতায় সুপ্রিম অবস্থানে থেকেও ইসলামপন্থী রাজনীতির সামগ্রিক প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারেনি জামায়াত। যেখানে তাদের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী এবং সেক্যুলার ধারার মতো তৃতীয় একটি ইসলামপন্থী ধারার আত্মবিকাশের সুযোগ ছিল সেখানে জামায়াতের অভিভাবকসুলভ প্রতিনিধিত্বশীল রাজনীতির ব্যর্থতায় তারা নিজেরাই হয়ে গেল বড় দলগুলোর খেলার পুতুল। ইসলামপন্থী রাজনীতির প্রতিনিধি হয়ে ওঠার গুরুত্বের চেয়ে ডানে বামে দৌড়াদড়ি করে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিতে তারা অভ্যস্ত হয়ে গেল। টিস্যু পেপারের মতো ব্যবহৃত হতে লাগলো দ্বিদলীয় খেলায়।
জামায়াত তার ভীষন শক্তিশালী প্রৌঢ় নেতৃত্বের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে কখনো চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। আমীরের আনুগত্যের ধর্মীয় আবেগে ভুল রাজনীতির তল্পি বহন করে গেছে সমস্ত জনশক্তি। ফরজ আনুগত্যের ধর্মীয় বয়ানে ব্যারিস্টার, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, মাওলানা, অধ্যাপক, প্রত্যেকের গর্দান আনুগত্যের রশি দিয়ে বেঁধে নিয়েছে তারা। জামায়াতের অভ্যন্তরে বদ্ধমূল ধারণার বাইরে নতুন চিন্তা, নতুন ধারার বিকাশ হয়নি। আপাত গণতান্ত্রিক এবং শূরা পদ্ধতি থাকলেও ঘুরেফিরে পুরনো নেতৃত্বে পুরনো সিদ্ধান্তে তারা তাদের প্রতিনিধি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা হত্যা করেছে। জামায়াত অপরাপর কিছু ইসলামপন্থীদের মতই বদ্ধমূল চিন্তা এবং ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পুরোপুরি গোড়াপন্থী। দলের অভ্যন্তরে যে কোন সংস্কার চেষ্টাকে গোমরাহী এবং ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখা হয়েছে। যারা রাজনৈতিক ক্যারিয়ার, সাংগঠনিক ভিত্তিকে জীবন-জীবিকা হিসেবে আঁকড়ে ধরতে পেরেছে তারা টিকে গেছে। যারা মেনে নিতে পারেনি তারা ছিটকে পড়েছে। উপর্যুক্ত দুটি প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি বলে জামায়াত তার প্রতিনিধিত্বের সুযোগ হাতছাড়া করে নিজেদের খোড়া গর্তে পড়েছে।