ফিলিস্তিনে জাতিসংঘ ও আমেরিকার বন্ধু সন্ত্রাসী ইসরাইলের গণহত্যার প্রতিবাদে ঈদের দিন বেচে নেয়া শাসনতন্ত্রের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ছিল। আমার ধারণা ছিল ঈদের দিন অন্যকোন রাজনৈতিক খবর না থাকায় এবং প্রথাবিরোধী দিন হওয়ার কারনে এই কর্মসূচি ব্যাপক মিডিয়া কভারেজ পাবে। এই বিক্ষোভ টি আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতো যদি খোদ পীর চরমোনাই যোগ দিতে পারতেন। তাঁর দল ও নগরনেতাদের কাজের ক্রেডিট তাঁর কাছেই যাবে। কিন্তু একজন ভবিতব্য জাতীয় নেতা হিসেবে তিনি যদি হাসিনা খালেদার পর্যায়ে যেতে চান; অবশ্যই তাকে স্বশরীরে মাঠের সক্রিয় রাজনীতির ভিতর দিয়ে যেতে হবে। যে বিষয়ে তাকে বরবরাই অনাগ্রহী মনে হয়। করোনার অযুহাতে গত দুই বছর প্রায় পুরোটা সময় তিনি প্রেস সেক্রেটারির লিখে দেয়া বিবৃতি ছাড়া জননেতাসুলভ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগত রাজনীতি করেছেন;তেমনটা আমাদের চোখে পড়েনি। ধর্মীয় উপদেশ সভাগুলোতে যাতায়াতে তাঁর হেলিকপ্টার ব্যবহারের অভ্যাস আছে। কাজেই সদিচ্ছা এবং রাজনীতির প্রতি সিরিয়াস কমিটমেন্ট থাকলে তিনি লকডাউনে ঢাকার বিভিন্ন প্রোগ্রামে হেলিকপ্টারে উড়ে আসতে পারতেন। চরমোনাই পীর এখন বহুল নন্দিত – সমালোচিত একটি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ক্যারেক্টার। অনুসারীরা তাকে একাধারে ধর্মীয় আধ্যাত্বিক ও রাজনৈতিক নেতা বলে পরিচয় দিতে আগ্রহী। শুধুমাত্র বরিশালে মাদ্রাসা,খানকা ও পরিবার নিয়ে পড়ে থাকার কারণে ঢাকার অনেক সেনসেটিভ প্রোগ্রামে তাকে উপস্থিত করানো যায় না। তার মত গুরুত্বপূর্ণ নেতার উচিত ঢাকায় ২য় মারকায চালু করে নিয়মিত অবস্থান করা। একই কথা দ্বীতীয় পীর ফয়জুল করীমের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দুই পীর ও প্রিন্সিপাল মাদানী ছাড়া বাকি ভাইরা দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে এসেছেন স্রেফ পারিবারিক কোটায়। এরপরও নিজেদের চেনানোর সুযোগ ছিল তাদের। সেটা তারা কোনদিন পারেন নি। কাজেই তাদের থাকা না থাকা একেবারেই গুরুত্বহীন।
ইসলামী আন্দোলন এখন সবচেয়ে বেশী প্রোগ্রাম করা দল। মিছিল টিছিল করে তারা চলে যায় কিন্তু বামদের মত প্রোগ্রাম থেকে নেতা তুলে আনার দক্ষতা তাদের নাই। ফলে দুই পীর,মাদানী,গাজী ছাড়া আর কাউকে জাতি চিনে না।
ফিলিস্তিনে শতাধিক মুসলিম গণহত্যার প্রেক্ষিতে বড় বিক্ষোভ হলে মিডিয়া কাভারেজ হবে এটা প্রত্যাশিতই ছিল। দেশী-বিদেশী প্রায় অর্ধশত মিডিয়ায় তাদের বিক্ষোভ ফোকাস পেয়েছে। এটা তাদেরকে দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক বেনিফিট দিয়েছে। তাদের কর্মীরা স্বাভাবিক ভাবেই চাঙ্গা। কিন্তু এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতা রক্ষায় যেই পলিটিকাল সিরিজ গেইম প্লান প্রয়োজন সে বিষয়ে তাদের গরজ দেখা যায় নি। ইস্যু লম্বা করতে জানা এবং ছড়িয়ে দিতে জানা প্রোগ্রাম পরবর্তী রাজনীতি। বিক্ষোভে তারা অন্যদের নিজেদের নেতৃত্বে যুক্ত করার সুযোগ হারিয়েছে। তাদের উচিত ছিল এই কমন ইস্যু নিয়ে সমমনা এমনকি বামদের আমন্ত্রণ জানানো। রাজনীতিতে মিত্র লাগে। দুনিয়ার কোথাও একা রাজনীতির খানা নাই। দ্বিতীয়ত: পরবর্তীতে গুচ্ছ কর্মসূচি ঘোষণা করে আরো বড় রাজনীতির গ্রাউন্ড তৈরি করা, প্রোগ্রাম প্রেক্ষিতে টকশো সম্প্রচারে সাংবাদিকদের সাথে লিয়াজো করা এসব অনেকগুলো ধারাবাহিক রাজনীতি তারা করছে না। ধর্মভিত্তিক দলগুলো রাজনৈতিক লক্ষ্যহীন। ফলে তারা মিছিল শেষে ঘুম দেয়।
“সরকার নামতে দেয় না” এই পীথাগোরাসীয় উপবাদ্য বানিয়ে নিয়ে জামায়াত বারবার তার ধর্মীয় দায় এড়িয়ে যায়। সাঈদী-নিজামী-মুজাহিদের জন্য গুলির সামনে যারা বুক পাতে; “নামতে দেয় না” অযুহাত তাদের জন্য বেমানান। ফিলিস্তিন ইস্যুতে সরকার নিজেও নমনীয়। এখানে জামায়াতকে সরকার অন্ততঃ গুলি করার সম্ভাবনা নাই, এটুকু স্পেস নিয়ে জামায়াত ব্যাপক বিক্ষোভ করতে পারতো। তাদের মিত্র বিএনপিকে নামাতে পারতো। আসলে জামায়াত অসময়ে তার শক্তি ক্ষয় করে ধর্মীয় ইস্যুতে এখন শাসনতন্ত্রের মত দলগুলোর কাছেও পিছিয়ে পড়ছে। ময়দানের আতঙ্ক শিবিরের দায়সরার মানববন্ধন ছিল শুধু করার জন্য করা। যত ফিলিস্তিনি খুন হয়েছে মানববন্ধনে শিবিরের তত লোক ছিলো না। শিবির প্রেসিডেন্ট ইংরেজি বক্তৃতা করেও কর্মসূচির প্রতি মিডিয়ার দৃষ্টি ফেরাতে পারেন নি। হত্যার প্রতিবাদ কখনো মানববন্ধন দিয়ে হয় না; এই রাজনৈতিক সেন্সটুকু এখন জামায়াত-শিবিরের নাই, এটা অবিশ্বাস্য।
শাসনতন্ত্র এখন অন্ততঃ ফিলিস্তিন ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মহলে সরাসরি চাপ সৃষ্টির জায়গায় যেতে পেরেছে। ওয়াশিংটন পোস্টে তাদের বিক্ষোভ ও বক্তব্য প্রচার হওয়ার মানে এটা জাতিসংঘ,ওআইসি ও বিশ্বনেতাদের দৃষ্টিগোচর হওয়া। এভাবে দেশে দেশে ছোট ছোট মুভমেন্টেও আন্তর্জাতিক প্রেসার ক্রিয়েট করা যায়- ঈদের দিনে ইসলামী আন্দোলনের বিক্ষোভের ভিতর দিয়ে এটা প্রমাণিত হয়েছে।
শাসনতন্ত্র ও তার নেতাদের উচিত নিজেদের দুর্বলতা কাটিয়ে আগামী রাজনীতির কম্পিটিটর হিসেবে নিজেদের স্মার্ট করে তোলা।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও রাজনীতি বিশ্লেষক