তার দল আচানক ঈদের দিনে বিক্ষোভ করে সবাইকে চমকে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গুরুত্ব দিয়ে তা প্রচার করেছে। আমার ধারণা, প্রতিটি মুভমেন্টের কিছু না কিছু ফলাফল থাকে। তার দলও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফিলিস্তিনের পক্ষে ম্যান্ডেট তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। যেমন যারা আমরা এক্টিভিস্ট কেউ স্বীকার করুক বা না করুক জায়গামতো এসব ছোটখাটো খোঁচাখুঁচির একটা ইতিবাচক প্রভাব ঠিক ই পড়ে।
এবার বড় পরিসরে বিশ্ব সংস্থা জাতিসংঘের কাছে তিনি যেতে চাইছেন। এর আগে ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে তার দলের দৃষ্টিভঙ্গি স্পস্ট হয়েছে। তারা বলেছে, “সন্ত্রাসী ইসরাইলের বিনাশ ই একমাত্র সমাধান।” সুতরাং পীরের দল দুইরাষ্ট্রনীতি প্রত্যাখ্যান করে অখন্ড ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চায়। কাজেই জাতিসংঘে এই বক্তব্যের নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক ডকুমেন্টেড বয়ান হাজির করে লজিক্যাল এক্সপ্লেইনেশন তাকে দিতে হবে। আমার ফর্মূলা হচ্ছে, শুধু এক পৃষ্ঠার দাবীনামা না দিয়ে জাতিসংঘকে সমাধানের একটা বিস্তারিত রূপরেখা দেয়া উচিৎ। এর জন্য তাঁর আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞ আল্লামা উপদেষ্টা মন্ডলীকে এবং তার জাতীয় শিক্ষক ফোরামের শত শত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কাজে লাগানো যায়। অধ্যাপক মাহবুব দীর্ঘদিন জাতীয় শিক্ষক ফোরামে সভাপতি হিসেবে বিবৃতি ও বার্ষিক কালারফুল সম্মেলনের পাশাপাশি এতদিনে যে কাজের কাজটি করেছেন, ঢাকা ও এর বাইরের কয়েকশত অধ্যাপক ও গবেষককে শিক্ষক সংগঠনে যুক্ত করেছেন। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ব্যাপক দাওয়াতী তৎপরতা নিয়ে তিনি গত এক দশকে লালদল নীল দলের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়ে একটি “সবুজ দল” গড়ে তুলেছেন। যারা ইসলামী ফ্লেভারে পেশাজীবী সংগঠন করে। শিক্ষকদের সংগঠিত করার এই পারফরমেন্সের স্বীকৃতি স্বরূপ আমীর বারবার তাকে জাতীয় শিক্ষক ফোরামের সভাপতি পদে বহাল রাখেন। এখন অধ্যাপক মাহবুবের অক্লান্ত শ্রমে এই সংগঠিত দলীয় শিক্ষকদের কাজে লাগানোর পালা।
তারা এই বয়ান নির্মান করবেন যে, এই সংকট নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ফ্রান্স ব্রিটিনের তৈরি করা। কাজেই ইসরাইলকে ওখান থেকে সরিয়ে নিজ দেশের অভ্যন্তরে শরণার্থী অথবা অধীনস্থ আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে তৈরি করুক। জাতিসংঘকে অবশ্যই ইসরাইলকে “স্থায়ী শরণার্থী/Permanent refugee” ঘোষণা করে নিরাপত্তা পরিষদে ইসরাইলের বন্ধুদের মাঝে ভাগ করে দিতে হবে। এভাবে আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘ আইন ও ইউএন এর ক্ষমতা বিশেষজ্ঞদের দিয়ে তৈরি করা এই বক্তব্য জাতিসংঘের আঞ্চলিক কার্যালয় ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূতাবাস সমূহে পাঠাতে হবে। ওআইসি,ইরান ও ফিলিস্তিনের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কুটনীতিকদের কাছেও পাঠাতে হবে। সকল আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় মেইল করে ইসরাইলের বিলুপ্তি এবং আমেরিকার ঘাড়ে এই আপদ তুলে দিতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে কিভাবে ইসরাইল বৈশ্বিক রাজনীতি ও নিরাপত্তা অস্থিশীল করার জন্য দায়ী তার ডকুমেন্টেড যুক্তি তুলে ধরে এই কৃত্রিম রাষ্ট্রের জন্য মার্কিন ও তার মিত্রদের দেশে বিকল্প আশ্রয়স্থল নির্দেশ করতে হবে। বিশেষত: চীন, রাশিয়া এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেও অত্যন্ত শক্তভাবে এই বার্তা তুলে ধরতে হবে। এটা নিয়ে একটা আন্তর্জাতিক বিতর্কের জন্মদেয়াই হবে পীর চরমোনাই’র বহির রাজনীতি।
আর অভ্যন্তরীনভাবে দুইটি বড় রাজনীতি তিনি করতে পারেন। এক। এই সুযোগে কুটনীতিক পাড়ায় ছোট ছোট টিম পাঠিয়ে তার দলের শান্তিবাদী উদার গনতান্ত্রিক রাজনীতির পরিচয় তুলে ধরতে পারেন। দলের সাথে আরব দেশসহ কূটনৈতিক পড়ায় সম্পর্ক তৈরি করতে পারেন।
দুই। ফিলিস্তিনে নারী ও শিশু সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত। তিনি তার এই কর্মসূচীতে দলের মহিলা উইং এর কিছু সদস্য রাখতে পারেন। এতে নির্বাচন কমিশনে প্রদেয় শর্তানুসারে তাঁর ৩০ শতাংশ নারী অংশগ্রহণ দেখানো যাবে। এবং তার দলের নারী রাজনীতির একটা দৃশ্যমান স্বীকৃতি দেয়া হবে। এক্ষেত্রে তিনি ফতোয়ার শিকার হবেন। কিন্তু নেতাকে ফতোয়া বাইপাস করার মত দুঃসাহসও মাঝে মাঝে দেখাতে হয়। ফিলিস্তিনে যেখানে নারীরা যুদ্ধ করে জীবন দিচ্ছে; সেখানে শরঈ পর্দাসহ বাংলাদেশের ৯ কোটি নারীর পক্ষেও প্রতিবাদ হওয়া উচিত।
শায়খ রেজাউল করীম যেহেতু নারীদেরও আধ্যাত্বিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা;নারী সম্পৃক্ততাও তার নেতৃত্বে হতে পারে। এটার ধরন ও পদ্ধতি প্রক্রিয়া নিয়ে অবশ্য আলাদা করে আলোচনার দরকার হবে।
কর্মসূচি: করোনা কালে সারাদেশে রাজনৈতিক মাঠ পুরাই খালি। তাই আসন্ন ইউপি নির্বাচনের আগে দেশব্যাপী তার অনুসারীদের একটা ঝাঁকুনি দিতে পারে ইসলামী আন্দোলন।
ক। ইসরাইলের উচ্ছেদ ও অখন্ড স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবীতে ১০ মিলিয়ন বা ১ কোটি মানুষের গণস্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মসূচী।
খ। ফিলিস্তিন সলিডারিটি ফান্ড রাইজিং।
গ। সিটি কর্পোরেশন এলাকার প্রত্যেক ওয়ার্ডে স্থানীয়ভাবে মানববন্ধন। ইউনিয়ন ও থানায় মিছিল/মানববন্ধন। এর মাধ্যমে গণস্বাক্ষর ও ফান্ড রাইজিং এর কাজও হাসিল হবে। ইস্যুটাও অনেকদিন জীবিত থাকবে। তৃণমূল কাজে থাকবে এবং ভোটের রাজনীতিতে তৃণমূলের সাথে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়বে।
প্রোগ্রাম কি করে ফলপ্রসূ করা যায়, সেটা একটি নিয়মতান্ত্রিক দলের ভালোই জানা আছে। আগাম প্রচারণায় বৈচিত্র্য এনে আগেই একটা আলোড়ন তুলতে পারে তারা। এপি, রয়টার্স,আল জাজিরা সহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সাথে আগেই যোগাযোগ করে তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। প্রোগ্রামে ফিলিস্তিনের সংস্কৃতি চিত্রায়ন ও আল আকসার প্রতিকী স্ট্রাকচার ব্যবহার হতে পারে। দলের আর্কিটেক্টরা এ কাজ করতে পারে। বাইডেন ও মানবতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারীদের প্রতি প্রতিকী ঘৃণা প্রকাশ করতে হবে।
ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক সম্পাদক ও পীর পরিবারের ৭ম সাহেবজাদা মুফতী সৈয়দ মুহাম্মাদ নূরুল করীম কাসেমীর সুযোগ্য নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ইতোমধ্যেই একাধিক উপ-কমিটি কাজ শুরু করে দিয়েছে। অতীতের মত ফিলিস্তিন ইস্যুতে এই তরুণ ও দেউবন্দ গ্রাজুয়েট মেধাবীনেতা দলকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মেলে ধরার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবেন।
সর্বোপরি হেফাজতের গণগ্রেফতারে ধর্মীয় অঙ্গনে সৃষ্ট শূন্যতায় পীর সাহেব চরমোনাইয়ের কাঁধে বাড়তি যে দায় এসে পড়েছে তা তিনি অনেকটা পূরন করতে পারবেন যদি সরকারের ছাড় দেয়ার সুযোগ কাজে লাগিয়ে ফিলিস্তিন ইস্যুতে বাঙালি মুসলমানের সর্বদলীয় ও সর্ববৃহৎ একটি ক্ষোভসমাবেশ আয়োজন করে দেখাতে পারেন।
জনাব রেজাউল করীমের নীতি হচ্ছে, তিনি কখনো শান্তির সীমা অতিক্রম করেন না। কাজেই এই প্রোগ্রামে লক্ষাধিক জনতার সমাগম হলেও শান্তিপূর্ণ উপায়ে তা শেষ হবে। এরপরও তার দলকে বাড়তি সতর্কতা নিতে হতে পারে।
ইসরাইলের অবৈধ কৃত্রিম ভাড়াটিয়া রাষ্ট্রের বিনাশ ও স্বাধীন ফিলিস্তিন যে কোন মানবিক বিবেকের একান্ত চাওয়া। আশা করা যায় সরকার এই মানবতাবাদী কর্মসূচিতে বাধা দিবেনা। প্রত্যেক সচেতন নাগরিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উচিত এই বড় কর্মসূচীতে নিজেদের সমর্থন ব্যক্ত করা।
বিশ্ব দেখুক, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ স্বাধীনতার নায্য সংগ্রামে কিভাবে সীমান্তের বাধা পেরিয়ে জাতিগত ঐক্যবদ্ধ সমর্থন ঘোষণা করে। চরমোনাই পীরের এই কর্মসূচি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মানবতাবাদী ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল করে তুলবে। পরাশক্তিগুলো দেখবে জালেম ও মজলুমের যুদ্ধে কোন নিরপেক্ষতা ও নিরবতা থাকতে পারে না।
লেখক-
সাবেক ছাত্রনেতা, বিতর্ক সংগঠক, রাজনীতি সমালোচক ও সমাজচিন্তক।