বিখ্যাত ছিলেন কাজী কাফী নামে। বর্তমান তুরস্কের আকহিসারের কাজী, পুরো নাম: হাসান ইবনে তুরখান ইবনে দাউদ ইবনে ইয়াকুব আল-আকহিসারী আয-যীবী। একজন আরবি বৈয়াকরণ, ইসলামি আইনবিদ, নীতিতত্ত্ববিদ, দার্শনিক, যুক্তিবিদ, কবি, সাহিত্যিক, বিচারপতি, সমাজ সংস্কারক ও অসীম সাহসী বীর যোদ্ধা; তিনি তাঁর সময়কালে একজন শ্রেষ্ঠ ও প্রধান আলেমে দীন ছিলেন।
তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন বসনিয়ান,১৩৮৬ খ্রিস্টাব্দে কসোভো যুদ্ধে উসমানী মুসলিম বাহিনীর হাতে পরাজয়ের পর ইউরোপের বলকান অঞ্চলে ইসলামের অগ্রযাত্রা সূচিত হয়েছিল এর ফলশ্রুতিতে ১৪৬৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সার্বিয়া ও বসনিয়ায়ও ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়ে। কাজী কাফীর পূর্বপুরুষদের মধ্যে মরহুম ইয়াকুবই প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন আকহিসার বিজেতা সুলতান সুলায়ান কানুনীর নিকট।
তিনি সুলতানকে অল্প কিছুদিন পেয়েছিলেন, কাজী কাফীর পিতা মরহুম দাউদ সুলতানের সাথে সাত বছর বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে বীরত্বের সাথে লড়াই করেন এবং অবশেষে বসনিয়ার হারাওয়াত দূর্গ বিজয়ের সময় শাহাদতের অমীয় সুধা পান করেন। সুলতান সুলায়মান কানুনীর আমলেই ১০২৫ খ্রিস্টাব্দে কাজী জন্ম গ্রহণ করেন।
কাজী হাসান ইবনে তুরখান আল-আকহিসারী (মৃ. ১৫৪৪ হি.)-এর সাথে প্রথম পরিচিত হই তাঁর বিখ্যাত আকীদাতুত তাহাবীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ নূরুল ইয়াকীন ফী উসূলিদ্দীনের মাধ্যমে। যখন আমি উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমে দীন ও দার্শনিক ব্যক্তিত্ব হাকিমুল ইসলাম আল্লামা কারী তাইয়িব (মৃ. ১৪০৩ হি.) প্রণীত শরহুল আকীদাতিত তাহাবিয়ার তাহকীক ও তথ্য-উপাত্ত সম্পাদনা করছিলাম। তখন কাজী কাফীর উপর্যুক্ত কিতাবটির সন্ধান পাই এবং একই সঙ্গে তাঁর সাথেও পরিচিত হই।
কাজী কাফী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা নিয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। বহুভাষী কাজী আরবি, তুর্কি, ফার্সি ও বসিনিয়ান স্থানীয় ভাষাসমূহে বেশ পারদর্শী ছিলেন। তবে তাঁর বেশির ভাগ রচনা ক্রমান্বয়ে আরবি, ফার্সি ও উসমানী আমলের তুর্কি ভাষায় প্রণীত। একুশটির মতো মহামূল্যবান গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায় তাঁর। এর মধ্যে একটি মৌলিক ও মূল্যবান গ্রন্থ হচ্ছে, উসূলুল হুকুম ফী নিযামিল আলম অর্থাৎ বিশ্বশাসনের নীতি।
আরবি ভাষায় রচিত অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত কিতাবটির আলোচ্য বিষয় হচ্ছে রাজনীতি। ইউরোপ ও পশ্চিমা বিশ্বে গ্রন্থটি বহুবার প্রকাশিত ও মুদ্রিত হয়েছে। এমনকি ইংরেজি ও জার্মান ভাষায় অনুদিতও হয়েছে। বর্তমান ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের তেহরানস্থ মিরাসে মকতুব থেকে সম্প্রতি যে আধুনিক তাহকীক ও তথ্য-উপাত্ত সমৃদ্ধ সংস্করণটি বেরিয়েছে তার পৃষ্ঠা সংখ্যা ভূমিকাসহ ৯৬ পৃষ্ঠা। এর মধ্যে ভূমিকাই হচ্ছে ৩৮ পৃষ্ঠা, বাকি ৫৮ পৃষ্ঠা হচ্ছে মূল কিতাব।
কিতাবটিতে রাজনীতির চারটি মূলনীতির কথা আলোচিত হয়েছে। রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা, এর গুরুত্ব ও ফযীলতের ওপর একটি ভূমিকার পরই চার মূলনীতির কথা উল্লেখ করেন চারটি স্বতন্ত্র অধ্যয়ে।
চার মূলনীতিগুলো হচ্ছে,
১- আদল ও ইহসান (ইনসাফ, ন্যায়বিচার, সমৃদ্ধি),
২- মুশাওয়ারা (পরামর্শভিত্তিক শাসনব্যবস্থা),
৩- সামরিক শক্তি অর্জন, অস্ত্র উদপান ও সক্ষমতা লাভ করা ও
৪– বিজয় ও আল্লাহর সাহায্য লাভের সূত্র।
তিনি তাঁর প্রত্যেকটি মূলনীতি শুরু করেছেন একটি কুরআনের আয়াত ও একটি হাদীস দিয়ে। অতঃপর জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি, দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। এরপর পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে ন্যায়পরায়ণতার প্রবাদপ্রতীম বিভিন্ন শাসকদের অতুলনীয় নজিরগুলো তিনি একে একে পেশ করেন। বাণী হিসেবে তিনি গ্রিক দার্শনিকদের বক্তব্য এবং ইনসাফের উদাহরণ হিসেবে প্রাচীন ফারস্যের পৌত্তলিক আমলের বিভিন্ন শাসকদের কথাও তুলে ধরেছেন।
কিতাবটি পড়ে সংক্ষিপ্তভাবে যা বোঝা গেল তা হচ্ছে, রাজনীতি একটি দুনিয়াবি, ইহজাগতিক ও পার্থিব কাজ। এর সাথে ধর্মের সম্পর্ক আসলে নৈতিকতার। যেমন ব্যবসায়-বাণিজ্য, ব্যবসা সত্তাগতভাবে ইবাদত নয়, একটা জাগতিক কাজ। হ্যাঁ, ব্যবসায় অসাধুতা পরিহার করা, ভেজাল না করা, ওজনে কম না দেওয়া ইত্যাদি নৈতিক নিষেধ রয়েছে শরীয়তের পক্ষে। রাজনীতিটাও ঠিক এমনই।
কিতাবটিতে যে চারটি মূলনীতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার সবই জাগতিক বাস্তবতার সাথে সম্পূর্ণই সংগতপূর্ণ। এখানে শরীয়া কায়েমের দাবিকে মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, অনেকেই মনে করতে পারেন সেই সময় রাষ্ট্রে শরীয়ত বাস্তবায়িত ছিল, সেজন্য সেই দাবির প্রয়োজন ছিল না। বস্তুত শরীয়ত বাস্তবায়িত থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তি শাসকের সদিচ্ছা না থাকলে বেইনসাফি হতে পারে। যেটা ইসলামের তবিয়ত ও তাকাযার পরিপন্থী। এই কারণে শরীয়া শাসনের চেয়ে মুসলিম নীতিবিজ্ঞানীদের জোর ছিল ইনসাফের ওপর, ইহসানের ওপর এবং বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থার ওপর।
রাজনীতি একটি দুনিয়াবি কাজ। দুনিয়াবি ক্ষেত্রে যদি রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণকর হয় তাহলে অমুসলিমদের ধারণাকেও কাজে লাগানো যেতে পারে। এই কিতাবে যেভাবে গ্রিক দার্শনিক ও পৌত্তলিক শাসকদের ভুরিভুরি উদাহরণ পেশ করা হয়েছে তাতে এটিই প্রতিয়মাণ হয়। কাজেই মুসলিম বিশ্বে স্বৈরচারী শাসনের মোকাবেলা এবং শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রকে কাজে লাগানোর বিষয়টি গুরুত্বের বিবেচ্য হতে পারে এবং বর্তমান পার্লামেন্ট ব্যবস্থাকে শুরায়ী নিজামে রূপ দেওয়া যেতে পারে।
মুসলিম উম্মাহর মুক্তি, স্বাধীনতা ও সফলতার জন্য বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এবং সামরিক শক্তিতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের যে বিকল্প নেই কিতাবটি সেই সবকই দেয়। বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে মুসলিম বিশ্ব সম্পূর্ণই পরনির্ভরশীল, সামরিক শক্তি ও অস্ত্র উৎপাদনে কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। এই অবস্থায় রাষ্ট্রকে শক্তিশালী, জাতিকে শিক্ষিত এবং প্রজন্মকে আধুনিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ করতে হবে। আর এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হবে উম্মাহর কল্যাণ এবং তাকে শক্তিশালী করা। পরিশেষে সফলতার জন্য আল্লাহর সাহায্য ও নুসরত প্রার্থী হওয়া এবং হতাশ না হয়ে সফল হওয়ার বিভিন্ন সূত্র ও কারণ বর্ণনা করা হয়েছে।
লেখক
ছগির আহমদ চৌধুরী
লেখক, অনুবাদক ও রাষ্ট্রচিন্তক